গুয়াহাটি: কোলে রয়েছে সন্তান। দু’চোখে শূন্যদৃষ্টি।  সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে। কখনও রোল উঠছে কান্নার। কখনও আবার ফটক ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা। উর্দি পরা কাউকে নাগালের মধ্যে পেলে পায়ে লুটিয়ে পড়ার অবস্থা। অসমের বিভিন্ন থানায় এমনই দৃশ্য চোখে পড়ছে গত কয়েক দিন ধরে, যার নেপথ্যে রয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী রাজ্য পুলিশের অভিযান এবং ব্যাপক ধরপাকড় (Assam on Child Marriage)।


বাল্যবিবাহ রুখতে পুলিশের অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড়


স্বাধীনতার আগে ও পরে, বিগত কয়েক দশক ধরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী অভিযান চলে আসছে দেশে। তাতে ব্যাপক পরিবর্তনও চোখে পড়েছে সমাজে। কিন্তু দেশের কিছু জায়গায় এখনও চলে আসছে মধ্যযুগীয় সেই প্রথা। সতর্কতামূলক প্রচারে ভর করে, কখনও আবার আইনি উপায়ে  তা নিরসনের প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে তা নিয়ে কড়া অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছে অসম সরকারকে (Assam News)।


শনিবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ২ হাজার ২৫৮ জনকে গ্রেফতার করেছে অসম পুলিশ। যদিও রাজ্যের দাবি, গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ১৮০০ জনকে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দু পুরোহিত এবং মুসলিম মৌলবিরাও, তাঁদের পৌরহিত্যে বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিযোগ পুলিশের। এখনও পর্যন্ত ৮ হাজার অভিযুক্তের নাম অসম পুলিশের হাতে এসেছে বলে জানা গিয়েছে। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বাল্যবিবাহের মামলা দায়ের হয়েছে ৪ হাজার ৭৪টি।


গত ২৩ জানুয়ারি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সার্বিক সচেতনতা তৈরির উপর জোর দেওয়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অসমের রাজ্য মন্ত্রিসভায়। প্রাথমিক ভাবে ২৩ জন অভিযুক্তের গ্রেফতারির নির্দেশ মেলে। কিন্তু গত কয়েক দিনে এই অভিযান ব্যাপক আকার ধারণ করেছে অসমে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিমি নামের এক মহিলা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত ২টোয় দরজায় টোকা শুনতে পান। দরজা খুলে দেখতে পান বাইরে দাড়িয়ে রয়েছে পুলিশ।  কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর স্বামীকে টানতে টানতে বার করে নিয়ে যায় পুলিশ। দেড় মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে ঘরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।


নিমি জানিয়েছেন, ১৭ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গোপাল বিশ্বাসকে বিয়ে করেন তিনি, যাঁর বয়স ২০-র মাঝামাঝি। বছর খানেক আগে বিয়ে হয় তাঁদের। সবে সন্তান হয়েছে। পকোড়া বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছিলেন গোপাল (দু’জনেরই নাম পরিবর্তিত)। গোপালের বলেন, “নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। নিমি এবং তাঁর ছেলেকে দেখব কী ভাবে? গোপাল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে নিমি কিছু খায়নি। ছেলেটিও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।”


একই ভাবে মধ্যবয়সী রেজিনা জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধে ৬টা নাগাদ বাড়িতে ঢুকে তাঁর ছেলে রাজিবুল হুসেনকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। সবে কেরল থেকে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন রাজিবুল। রেজিনা বলেন, “আমার বউমা নাবালিকা নয়। আধার কার্ডে কিছু গলদ ছিল। তার জন্যই জেলে ঢোকানো হয়েছে ছেলেকে। বউমা আমাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে জন্মের শংসাপত্র আনতে গিয়েছে।” এক প্রতিবেশিও জানান যে, রাজিবুল এবং তাঁর স্ত্রী, দু’জনই প্রাপ্তবয়স্ক। আধার কার্ডে লেখা জন্মতারিখ এবং সালই ভুল।


আরও পড়ুন: Aadhaar card: আধার কার্ডে ঠিকানা বদলাতে চান ? জেনে নিন, কী রয়েছে নিয়ম


স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকেই তথ্য চাওয়া হয়। আধার কার্ডের তথ্যই তুলে দেন তাঁরা। কিন্তু আধারকার্ডে প্রচুর ভুল তথ্য রয়েছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে জন্মের আসল শংসাপত্র খুঁজতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন সকলে। কিন্তু অনেকের জন্মের শংসাপত্রই নেই। স্বামীর মুক্তির জন্য প্রশাসনের মুখ চেয়েই বসে রয়েছেন তাঁরা।  সরকারি শেল্টার হোমে থাকা ১৬ বছরের রিয়ার প্রশ্ন, “পালিয়ে বিয়ে করেছি। দু’তরফেই বাড়ির কেউ পাশে নেই। এক বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে এখন কোথায় যাব?”  ১৮ বছরের এক মহিলা জানান, তাঁর স্বামী কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পালিয়ে বিয়ে করায় বাড়ির লোকজন পাশে নেই। একটি পয়সাও নেই তাঁর হাতে। কোলের সন্তানকে কী ভাবে মানুষ করবেন, তা-ই বুঝতে পারছেন না।


বাল্যবিবাহ রুখতে রাজ্য সরকারের এমন ধরপাকড়ের তীব্র সমালোচনা করছেন সমাজকর্মীরাও। অসমের সমাজকল্যাণ বিভাগর এক আধিকারিক বলেন, “এমন কতশত মেয়ে রয়েছেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে অভিযানকে স্বাগত। কিন্তু এই সব মেয়েদের প্রতি দায়িত্ববোধও তো আছে! মেয়েগুলি নিজেরাই ছোট। অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাবে এগোতে হবে। ওদের ভবিষ্যৎ যেন নিরাপদ থাকে।”


অসমে বাল্যবিবাহ চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আবার আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন মানুষের সংখ্যাও কম নেই। কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী আইন থাকলেও, রাজ্যে আগে কখনও তার প্রয়োগ হয়নি বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। সরকারের তরফে যথেষ্ট প্রচারাভিযানও চালানো হয়নি বলে অভিযোগ করছেন অনেকে। তবে এ সবের মধ্যেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা (Himanta Biswa Sarma)। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে তাঁর মনে কোনও সমবেদনা নেই বলেও জানান তিনি। তাঁর বক্তব্য, “এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সমবেদনা নেই আমার। অল্পবয়সে কোনও মেয়ের বিয়ে হলে, তার সঙ্গে যা ঘটে, তাকে ধর্ষণই বলতে হয়। কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাকে! আগামী দিনে লাখ লাখ মেয়েকে যাতে ভুগতে না হয়, তার জন্য এক প্রজন্মকে ভুগতে হবে। সবমেদনার প্রশ্নই নেই।”


এই নিয়ে হিমন্ত সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন রাজ্যে তৃণমূলের সভাপতি রিপুন বরা। তাঁর কথায়, “বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে দেশে, যা আজ বা কাল তৈরি হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটিই প্রশ্ন, এত বছর কেন ঘুমাচ্ছিল সরকার? আজ আচমকা হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, দেড়-দু’বছর আগে বিয়ে হয়। তখন বয়স কম থাকলেও, এখন তো সাজানো সংসার তাদের! ”


সরকারের এমন ধরপাকড়ের তীব্র সমালোচনা করছেন সমাজকর্মীরাও


জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, অসমে প্রসূতি এবং শিশু মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি। তার জন্য বাল্যবিবাহকেই দায়ী করা হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, যত বিয়ে নথিভুক্ত হয় রাজ্যে, তার মধ্যে ৩১ শতাংশই বাল্যবিবাহের আওতায় পড়ে। সে ক্ষেত্রে কেন সরকারের তরফে সচেতনতা তৈরিতে জোর দেওয়া  হল না, গাফিলতি ঢাকতে নির্বাচনী  স্বার্থকে সামনে রেখেই ব্যাপক ধরপাকড় হচ্ছে কিনা, উঠছে প্রশ্ন।