পল্লবী দে, কলকাতা: কৃষ্ণপক্ষের অবসান  এবং শুক্লপক্ষ বা দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যার একটি নির্দিষ্ট ক্ষণকে সনাতন ধর্মে  গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। পুরাণ এবং শাস্ত্রের বেশ কিছু তথ্য এবং ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে এই দিনটিকে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই দিনটিকে কেন 'মহালয়া' বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে অবশ্য 'নানা মুনির নানা মত'।



বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘মহালয়’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত উৎস মহৎ এবং আলয়। কিংবা মহত্ত্বের আলয়ও বলা যেতে পারে। এই মহালয় শব্দ থেকেই স্ত্রীবাচক পদ এসেছে- মহালয়া। ব্যাকরণ অনুযায়ী, তিথি শব্দটি যেহেতু স্ত্রীলিঙ্গ, তাই এর বিশেষণ পদটি হল মহালয়া। তবে এই মহালয়ার শব্দের নানাবিধ অর্থ রয়েছে। যেমন, মহালয় প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, যে ক্ষণে পরমাত্মায় অর্থাৎ পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্তি ঘটে সেটিই হল মহালয়। কেননা, পরমাত্মাই হল পরব্রহ্ম। আর নিরাকার ব্রহ্মের আশ্রয়ই হল মহালয়।

তবে শ্রী শ্রী চণ্ডিতে মহালয় হচ্ছে পুজো বা উৎসবের আলয়। এখানে আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। চণ্ডিতে তাই 'মহালয়' বলতে 'পিতৃলোককে ' বোঝানো হয়েছে। পিতৃলোককে স্মরণের ক্ষণকেই বলা হয়েছে মহালয়া। এই সন্ধিক্ষণটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথ ধরে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। বলা হয়, মহালয়া হয় অমাবস্যা তিথিতে যা উত্তরায়ণের শেষ সময়। এরপরই সূর্যের দক্ষিণায়ণ গতি শুরু হয়। যা শুভ বলে বিবেচিত নয়। কৃষ্ণপক্ষে কালিমার ক্রমশ লয় হতে হতে অমাবস্যা তিথিতে সে লয় পূর্ণতা পায়। তাই একে বলে মহালয়া।


আরও পড়ুন, মহালয়ার দিনেই কেন তর্পণ করা হয়?



এদিকে, ‘মহালয়া’ শব্দের সন্ধি বিশ্লেষণ করলে যেমন আরেকরকম অর্থ পাওয়া যায়, তেমনই অভিধান থেকে জানা যায়, ‘মহ’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। এক, ‘মহ’ বলতে বোঝায় পুজো বা উৎসব। তা থেকে ব্যুৎপত্তি করলে হয়  মহ+আলয় = মহালয় অর্থাৎ পুজো বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আবার ‘মহ’ শব্দের আরেক অর্থ 'প্রেত'। অর্থাৎ প্রেতের আলয় (আশ্রয়)।  সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। সেই মহালয় থেকে মহালয়া।

এবার আসা যাক মহাভারত প্রসঙ্গে। পিতামহ ভীষ্মের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ থেকে কর্ণের মৃত্যু ও ফের পৃথিবীতে এসে পিতৃপুরুষকে অন্ন-জলের নিবেদনের কাহিনিতে এর অর্থ আলাদা। ব্যাসদেবের লিখনিতে ‘মহালয়’ বলতে ‘পিতৃলোক’কে বোঝানো হয়েছে। যেখানে বিদেহী পিতৃপুরুষের অবস্থান। সেক্ষেত্রে পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই হল মহালয়া।

যদিও অনেক ভাষাবিদেরা প্রশ্ন তুলে থাকেন যে মহালয় শব্দকে  স্ত্রীলিঙ্গ কেন করা হল? এ বিষয়ে ভাষাগত কিংবা ব্যাকরণগত সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শাস্ত্রবিশেষজ্ঞরা জানান যে পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকজ্জ্বল দেবীপক্ষকে আগমন করি, তাই সেই মহা লগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়া’। এক্ষেত্রে দেবী দুর্গাকেই সেই মহান আশ্রয় বলা হয়ে থাকে এবং আঁধার থেকে আলোকে উত্তরণের লগ্নটিকে বলা হয় মহালয়া।

তথ্যসূত্র-

পূজা প্রকৃতি: আধ্যাত্মিক অনুধ্যান- শ্রীমৎ সৌমেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

শ্রী শ্রী চণ্ডি,

মার্কেণ্ডেয় পুরাণ- দেবীমাহাত্ম্যম

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা

ব্যাসদেব রচিত মহাভারত (কুরুক্ষেত্রপর্ব)