সুমন দে :
যাকে বলে একেবারে আগুনখেকো নেতা ! মাঠে ময়দানে যেমন চাঁচাছোলা বক্তব্য, স্টুডিওতেও তেমনি সপ্রতিভ। ময়দানের মস্ত বিতর্কসভার অর্ধেক গড়াতে না গড়াতেই আড়চোখে দেখছিলাম রীতিমতো উসখুশ করছেন। নির্ধারিত সময়ে তাঁর বক্তব্যেও বারবার সেদিন যেন ছন্দপতন ঘটল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার মিনিট পনেরো আগে রহস্যভেদ হল। সিনিয়র সেই রাজনীতিবিদ সটান আমার চেয়ার অব্দি উঠে এসে আমার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিলেন--"অনুষ্ঠানের মধ্যে যে একবারও বিজ্ঞাপনের বিরতি নেবে না, কী করে জানব? আমার ডায়াবেটিস আছে তো! একবার বিরতি দাও বাবা... ঘুরে আসি!"
তবে লাইভ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের বিরতির সময় যে কত স্মৃতি, মনে রাখার মত গল্প, এমনকি ইতিহাসেরও জন্ম দিয়েছে , তার একমাত্র সাক্ষী মহাকাল। আমার ধারণা, যে কোনও পেশাদার সঞ্চালককে সারা বছর ধরে সবথেকে বেশিবার দর্শকদের যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে --"আচ্ছা ওই যে ওনারা স্টুডিওতে অত ঝগড়া করেন , বিরতিতেও কি ঝগড়াটা চালিয়ে যান নাকি ভাব হয়ে যায়?" এই প্রশ্নের উত্তরে আসার আগে, চূড়ান্ত ভাব-ভালবাসা আর তিক্ততম তরজার দু-একটা উদাহরণ আপনাদের সামনে রাখা যাক।
"উফ, ওই একটা বিজ্ঞাপন-বিরতির স্মৃতি - মন থেকে মুছে গেলেই ভাল হয়" প্রায় আঁতকে উঠে বলেছিল ব্রাত্য। তখনও শিক্ষামন্ত্রী নয়, তরুণ তুর্কী নাট্যকার সে সময়ে আমার সন্ধের অনুষ্ঠানের নিয়মিত অতিথি। আর্কাইভ বলছে, তারিখটা ১২ মে ২০১০, পুরভোটের প্রচার তখন তুঙ্গে। সে বিরতিটা নিতে হয়েছিল নিছক বাধ্য হয়েই, কারণ কংগ্রেসের নির্বেদ রায়-অরুণাভ ঘোষের সঙ্গে শিল্পী শুভাপ্রসন্নর তীব্র বাদানুবাদ, যা নেমে এসেছিল ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে। বিরতির আগেই 'লাইভ' অনুষ্ঠানের সুবাদে দর্শকরা শুনে ফেলেছিলেন 'জালি', 'অসভ্য', 'দালাল', 'অশিক্ষিত', 'মাল'-জাতীয় 'অসংসদীয়' শব্দের বহুল-বিষাক্ত ব্যবহার। ভেবেছিলাম, বিরতি নিলে অন্তত পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হবে, কিন্তু কোথায় কী! গরম চাটু থেকে জলন্ত উনুনে পড়ার প্রবাদটার মতোই বিরতির ঘোষণা হতেই এক বিদ্বজ্জন অন্য পক্ষকে 'সারমেয়' বলে ফেললেন! ব্যস, তক্ষুণি হাতাহাতি বাধে আর কী! বিরতির পর ফিরে এসে অবশ্য অনুষ্ঠানের রাশ ধরেছিলাম শক্ত হাতে। তবে এই বিরতিটিতে বিশিষ্টজনের অশিষ্ট তরজা না দেখতে পেয়ে দর্শকরা অবশ্য নিশ্চয়ই কিছু 'মিস' করেননি।
তবে, অনেকের মতে যে সিঙ্গুর প্রকল্পের জন্য বহুলাংশে বামেদের চৌত্রিশ বছরের রাজ্যপাট 'মিস' হয়ে গেল, কী করে ভুলি, ঘটনাচক্রে তার সূত্রপাতটা ছিল ইতিবাচক। সূত্রপাতটা হয়েছিল এমনই এক সাক্ষাৎকারের বিরতির সময় থেকেই। ১১ মে, ২০০৬। ২৩৫টি আসন বগলদাবা করে বামফ্রন্টের ঐতিহাসিক জয়ের ফল ঘোষণার দিন। যাঁর নেতৃত্বে জয় সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। বিরতিতে একটা চিঠি মারফত খবর এল। রতন টাটার। বুদ্ধবাবুর মুখে চওড়া হাসি - "ওদের লোক পরশু সকালে আসছেন, দু-তিনটে জায়গা তাঁরা আগে এসে দেখে গেছেন। আপনাদের আগে বলিনি।" ব্যস, এক্সক্লুসিভের ওপর এক্সক্লুসিভ! বিরতি শেষেই প্রশ্ন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সহাস্য উত্তরও - "ভাল উপহার। পশ্চিমবঙ্গে শেষ পর্যন্ত একটা অটোমোবাইল ফ্যাক্টরি করার ডিসিশন নিয়েছেন। ...ওই যে স্মলেস্ট কার।" বাকিটা ইতিহাস।
ইতিহাস হয়তো মনে রাখে না, কিন্তু কত যে স্বজনহারার বুকফাটা কান্না আর চোখের জলের বাঁধ দেওয়ার কঠিন কাজটাও বিরতিতেই করতে হয় পেশাদার সাংবাদিককে! রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর পর স্টুডিওতে আনতে হয়েছিল রিজের মা সদ্যপ্রয়াত কিসওয়ার জাহানকে, সাংবাদিকতারই স্বার্থে। ক্রন্দনরত বৃদ্ধাকে বিরতিতে কিছুটা শান্ত করলেও সেদিন বিরতির পর ফিরে তিনি শুধু তিনটে শব্দই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন গোটা অনুষ্ঠানে, আর সেটুকুই নাড়িয়ে দিয়েছিল ক্ষমতার ভিত - "হামে ইনসাফ চাহিয়ে।" ক্ষমতা বদলের পর আমিনুল ইসলাম বা আনিস খানের বাবাদের ওই বিজ্ঞাপনের বিরতিতেই শান্ত করতে করতে মনে হচ্ছিল কত দ্রুত ঘটে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি -- অন্তত এ রাজ্যে।
তবে এ রাজ্যের রাজনীতিবিদরা সবাই জিনগতভাবে রামগরুড় আর বিরতিতে তাঁরা সবাই শুধু গোমড়ামুখে পরস্পরকে মাপেন -- এটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। রাজ্যের মন্ত্রীর কাছে বিরোধী দলের নেতা সদ্য পাশ করা ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করছেন বা কয়েক মিনিট আগে তুলোধনা করা প্রতিদ্বন্দ্বীকে মেয়ের বিয়ের কার্ড ধরিয়ে উষ্ণ নেমতন্ন করছেন -- অনুষ্ঠানের 'ছোট্ট' বিরতির সামান্য ফাঁকটুকুতে, এমন টুকটাক সৌহার্দ্য এবং ‘বড়‘ সুবিধেবাদের ঘটনাও আকছার ঘটে আমাদের চোখের সামনেই। "আমার কাছে স্টুডিও-র বিতর্ক অনেকটা নাটকের মঞ্চের মতোই", খোলা মনে একদিন মনের কথাটা বলেছিল ব্রাত্য, "মঞ্চে উঠে যে-যার রাজনীতির 'পার্ট' বলা, তারপর বিজ্ঞাপনের বিরতিতে উত্তেজনার রেশটুকুও না-রেখে একসঙ্গে চা-সিগারেট খাওয়া।" সেদিন শিক্ষামন্ত্রীর স্বীকারোক্তি ছিল, "এবিপি আনন্দর বিজ্ঞাপনের বিরতিগুলোই আমাকে সহিষ্ণুতা শিখিয়েছে।"
অনুষ্ঠান চলাকালীন অসীম ধৈর্য নিয়ে বিরতির জন্য অপেক্ষা করার শিক্ষণীয় নজির অবশ্য দেখেছি বছর দশেক আগে, লন্ডনে। ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কমেন্ট-এ ব্রিজ স্ট্রিটের দিকে পিঠ রেখে জমিয়ে বসে একটি মাল্টিক্যাম সাক্ষাৎকার নিচ্ছি ওখানকার পুজোর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র-র। প্রতি ফ্রেমে ব্যাকগ্রাউন্ডে হয় বিগ বেন, নয় তো হাউসেস অফ পার্লামেন্ট। আবহ-র উত্তেজনায় খেয়ালই নেই লন্ডন পুলিশ বা কোনও প্রশাসনিক সংস্থার কাছ থেকে শুটিং-এর ন্যূনতম অনুমতিও নেওয়া হয়নি! পাক্কা এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকার যখন শেষ হল, হতবাক হয়ে দেখলাম লন্ডন পুলিশের উচ্চপদস্থ দুই আধিকারিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরার লেন্সের নাগাল বাঁচিয়ে। অনুমতিপত্র নেই শুনে তাঁরা যে শুধু হাতে-গরম একটি অনুমতিপত্র ওখানেই সই করে দিলেন তাই নয়, সবিনয়ে জানালেন, গত পঞ্চাশ মিনিট ধরে তাঁরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন শুধু একটা বিজ্ঞাপন বিরতির জন্য, কারণ অনুমতির খোঁজখবর নিতে গিয়ে তাঁরা টিভি সাক্ষাৎকারটির মাঝে ছন্দপতন ঘটাতে চাননি!
দলাদলিক্লিষ্ট এ রাজ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক-অনুষ্ঠানে ছন্দপতনের ঘটনা লিখতে বসলে অবশ্য আর একটা মহাভারত হয়ে যাবে। ২০০৮-এর ২৪ ডিসেম্বর, নন্দীগ্রাম থেকে 'লাইভ' অনুষ্ঠান। হঠাৎই বেঁকে বসলেন তৎকালীন বিরোধী দলের মহারথীরা -- কিছুতেই শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে একমঞ্চে বসবেন না। অতএব লম্বা একটা বিরতি নিয়ে ডেকরেটরকে দিয়ে দুটি মঞ্চ কার্যত কেটে 'আলাদা' করে অনুষ্ঠান করতে হল! কিংবা ওই বছরই রাস্তা কেটে বিচ্ছিন্ন লালগড় থেকে প্রথম টিভি শো। মঞ্চের ওপরে পরবর্তীকালে মাওবাদীদের গুলিতে নিহত ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চার নেতা বাবু বসু, পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো এবং সিপিএম জোনাল কমিটির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক অনুজ পান্ডে -- প্রথম এবং শেষবারের জন্য পাশাপাশি! অনুষ্ঠানে এক যুবক তাঁর স্ত্রীর ওপর পুলিশী অত্যাচারের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিল। পরের বিরতিতেই দেখলাম যুবকটিকে ঘিরে ধরে তৎকালীন শাসকদলের পেশীশক্তির ধারকরা রীতিমতো গণধোলাই দিচ্ছে ওই লালগড় রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়- প্রাঙ্গণেই! বিজ্ঞাপন বিরতি দীর্ঘায়িত করে সেদিন উন্মত্ত গুন্ডাবাহিনীর হাত থেকে যুবককে বাঁচাতে এই সঞ্চালক ও টেকনিকাল টিমকে নামতে হয়েছিল মঞ্চ থেকে। অথবা ধরুন, রাজীব দাসের স্মৃতিতে বারাসাতের কাছারী ময়দান থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়া সেই অনুষ্ঠান, সেখানে বিরতিতে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে পাক্কা দশ মিনিট ধরে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছিল (১৭.২.১১)। তবে এসব কিছুকেই ছাড়িয়ে যেতে পারে ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের আগে বারাসাতের রবীন্দ্রভবন থেকে সরাসরি 'বলুন সাংসদ' অনুষ্ঠান -- বিজ্ঞাপনের বিরতির রাজনৈতিক তাৎপর্যে! ১৮ মার্চ সন্ধেবেলা প্রধান দলগুলির প্রার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছে - খোশমেজাজে সবে দ্বিতীয় বিরতির ঘোষণা করছি, এমন সময়ে মঞ্চে দু'দলের কিছু সমর্থক উঠে এল। নিজের নিজের সমর্থকদের সঙ্গে নেতারা মঞ্চ ছেড়ে পিছনের মেকআপ রুমে আশ্রয় নিলেন শান্তিপূর্ণভাবেই। পনেরো মিনিটের মধ্যেই ম্যাজিকের মতো উত্তাল হয়ে উঠল বারাসাতের পরিস্থিতি। গোটা জেলায় খবর ছড়িয়ে পড়ল, দু'পক্ষের নেতারাই 'আক্রান্ত'। বিরতিতে এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আর কোনও সঞ্চালককে পড়তে হয়েছে কিনা জানা নেই। চোখের সামনে দেখছি দুই নেতাই সুস্থ শরীরে ফূর্তিতে আছেন, অথচ তাঁদের সমর্থকরা তাঁদের ওপর 'নির্দয় আক্রমণ'-এর প্রতিবাদে গোটা জেলার রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে! স্বভাবতই সেদিন বিরতি থেকে আর অনুষ্ঠানে ফেরা যায়নি, তবে আসল চমক অপেক্ষা করছিল পরদিন সকালে। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, দু'পক্ষের দু'নেতাই অনুষ্ঠান চলাকালীন 'প্রচণ্ড আঘাতে গুরুতর আহত' হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আর এক দলীয় মুখপত্র লিখল, অনুষ্ঠানের সঞ্চালকই নাকি পরিকল্পনা করে বিজ্ঞাপন-বিরতিতে নেতাকে আক্রমণের পরোক্ষ মদত জুগিয়েছেন! রাজনীতির বিরতিহীন রাজ্যে বিরতি নিয়েও এমন রাজনীতি হয়!
নির্বাচনী রাজনীতির উত্তাপে গোটা রাজ্য ফুটছিল তখন। তারিখটা ৭ মে, ২০০৯ -রাজ্যে দ্বিতীয় দফার ভোটপর্ব চলছে। স্টুডিওতে চলছে, 'কার দখলে দিল্লি' অনুষ্ঠানের তুমুল তরজা। কয়েক মিনিট আগে কাঁথিতে রাজনৈতিক সংঘর্ষে সেই ভোটপর্বে প্রথম মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছেছে। লাইভ অনুষ্ঠানে রাজনীতির হেভিওয়েটদের সরাসরি প্রশ্ন করছেন উপস্থিত দর্শকরা, সঙ্গে তাল ঠুকছেন বিশিষ্টরাও। চাপানউতোর-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাঝে প্রশ্ন করতে মাইক হাতে উঠে দাঁড়াল এক সুদর্শন যুবক। প্রথমেই নিজের পরিচয় দিল বাম ছাত্র-সংগঠনের সদস্য হিসেবে, প্রশ্নের লক্ষ্য, উপস্থিত হেভিওয়েট তৃণমূল নেতা। মুহূর্তে বিস্ফোরণ ! শুরু কর্কশতম বাকবিতণ্ডা! দু'পক্ষই বয়সের তফাৎ ভুলে প্রায় হাতাহাতির ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে তেড়ে গেল! আমাকেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা বিরতি নিয়ে যুযুধানদের থামিয়ে শান্তি-রক্ষার্থে দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়েছিল সেদিন! এই ঘটনা লেখার পর দু'পক্ষের পরিচয় না দেওয়াটা ঘোরতর অন্যায় হবে। তৃণমূলের পক্ষে ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা বর্তমানে জেলবন্দি পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তাঁকে সমর্থন করছিলেন কংগ্রেস নেতা নির্বেদ রায়। আর বাম ছাত্রনেতাটি তখনও খুব পরিচিত না হলেও আজ রাজ্য-রাজনীতির অতীব চেনা মুখ। শতরূপ ঘোষ।
হাতাহাতির গল্প থেকে এবার আসি হাত ধরাধরির গল্পে। বিতর্কিত অনুষ্ঠানটির নাম ছিল 'বিবেক বনাম দল'। দিনটা ১১ জানুয়ারি, ২০১০। সেই প্রথম প্রকাশ্যে লাইভ স্টুডিওতে বসে দলের বিরুদ্ধে কার্যত 'বিদ্রোহ' ঘোষণা করেছিলেন কবীর সুমন। প্রত্যক্ষ উপলক্ষ্য, তাঁর 'ছত্রধরের গান'টি নিয়ে দলে তীব্র আপত্তি। মতবিরোধ মেটাতে আসা ব্রাত্য বসু প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় 'দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙা'-র জন্য নরমে-গরমে বেশ দু'কথা শুনিয়ে দিয়েছেন কবীর সুমনকে, কিন্তু 'গানওলা' সেদিন যুক্তিতে-তর্কে-রসবোধে অপ্রতিরোধ্য মেজাজে। প্রায় পৌনে দু'ঘণ্টা জমাটি বাকযুদ্ধের পর অনুষ্ঠানের শেষ বিরতি। পার্থবাবুকে কবীর সুমনের সটান প্রশ্ন, "যা নিয়ে এত কথা বলছেন, সেই ছত্রধরের গানটা কি আপনি শুনেছেন?" পার্থ চট্টোপাধ্যায় 'না' বলাতে হাসতে হাসতে কবীরের বাউন্সার - "আপনাদের একটা অসুবিধে কী বলুন তো, তৃণমূলের অধিকাংশ লোকই গান শোনে না।" পার্থ - "আপনি বাঁকা কথা বলছেন কেন?" কবীর - "এটা কি দলবিরোধী কথা?" পার্থ - "না, দলবিরোধী নয়, তবে বাঁকা। তৃণমূলের অনেক বুদ্ধিজীবী আছে যাঁরা গান শোনে।" মজার কথা, এই তপ্ত কথোপকথনটা যখন চলছে কবীর সুমন সপাটে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে ফেলেছেন আর মুখেচোখে প্রবল অস্বস্তি সত্ত্বেও পার্থবাবু তা ছাড়াতে পারছেন না। বিরতি নিয়ে ফেরার পর দর্শকরা দেখলেন, চূড়ান্ত বিনয়ী কবীর সুমন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বলছেন - "হঠাৎ এত অফিসিয়াল হয়ে যাচ্ছেন কেন? আপনি তো বন্ধু।" ক্যামেরায় তখন কবীরের হাতের মুঠোয় ধরা পার্থর হাতের ক্লোজ শট। মাস্টারস্ট্রোক আর কাকে বলে!
তবে এখন দিনকাল দ্রুত পাল্টাচ্ছে। মাস্টারস্ট্রোকের কথা বাদ দিন , এখন বহু ক্ষেত্রেই স্টুডিওর মহারথীদের মাস্টারমাইন্ডটি আসলে অন্য কোথাও বসে প্রতিমুহূর্তে প্রত্যেক সেকেন্ডের প্রত্যেকটা শব্দ, বিরোধীদের তথ্য, সঞ্চালকের যুক্তি মনিটর করছে। ভোট-কুশলী সংস্থার হাইটেক দপ্তর বা আইটি সেল থেকে পরিচালিত হচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ বক্তাদের মোবাইল ফোনে জরুরি তথ্য বা নির্দেশ ভেসে আসছে। বিজ্ঞাপনের বিরতির অনাবিল হাসিঠাট্টাও তাই ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। বঙ্গের ভোট যত এগোচ্ছে, ততই শব্দের ডেসিবেলে এবং ঝগড়াঝাঁটির আবহে তাতছে স্টুডিওর হাওয়া। আর প্রতিদিন আরও কঠিন হচ্ছে সঞ্চালকের কাজ। দায়িত্ব কি কম? ব্যক্তিগত আক্রমণ যাতে এড়ানো যায়, তর্ক থেকে যেন তিক্ততা না ছড়ায়, আর সবচেয়ে বড় কথা, মতান্তর যেন মনান্তরে পৌঁছে না যায়। কাজটা যে কত কঠিন তা একমাত্র পেশাদার সঞ্চালকরাই বুঝবেন। আর দর্শকদের সেই চ্যালেঞ্জটা বোঝানোর জন্য এই লেখার সঙ্গে একটা ছোট্ট ভিডিও যোগ করছি গত সপ্তাহের একটি অনুষ্ঠানের। ইচ্ছাকৃতভাবেই উত্তেজনার পারদ কমাতে সঞ্চালককে বারবার চেষ্টা করে যেতে হয় বিতন্ডার বিষয়টি কিঞ্চিৎ লঘু করে দিতে -- শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটা তো চালাতে হবে ! তবে পরে জেনেছি , বেচারা সঞ্চালকের এই সব যাবতীয় চেষ্টায় জল ঢেলে এই ঝগড়া স্টুডিওর বাইরেও সেদিন নাগাড়ে চলেছে দু’পক্ষের গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত!
তবে এত সবে শুরু। উত্তেজনার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও ভরল বলে। বঙ্গে ভোট আসছে যে ! অতএব সঞ্চালকদেরও তৈরি থাকতে হবে বৈকি। তার জন্য বিশ্রামও প্রয়োজন। অনেক লিখলাম, এবার একটা বিরতি নেব কিন্তু প্লিজ।
ফিরে আসছি বিরতির পর…