বিনয় লাল: ১৯৪৫ সালের ৯ অগাস্ট, ৭৭ বছর আগে আজকের দিনে জাপানের নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল আমেরিকা। আকাশপথে হামলা হতে পারে বলে ভোর থাকতেই সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল সকলকে। কিন্তু যুদ্ধের আবহে সাইরেন কার্যতই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাস ধরে লাগাতার জাপানের ইতিউতি বোমা ফেলে আসছিল আমেরিকা। তাই ৯ অগাস্টের সকালটা অন্য রকম হবে, তা ভাবার কারণ খুঁজে পাননি কেউ। তিনিয়ান বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে রওনা দিতে তত ক্ষণে কোকুরার আকাশে পৌঁছে গিয়েছে আমেরিকার চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট দুর্গসমান দু’টি B-29 Superfortress যুদ্ধ বিমান (Nagasaki Atomic Bombing)। ওই যুদ্ধ বিমান ভারী ওজনের বোমা নিক্ষেপের কাজেই ব্যবহার করে আমেরিকা। ওই দিন সকাল ৯টা বেজে ৫০ মিনিটে কোকুরায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা নিক্ষেপ করার কথা ছিল যুদ্ধ বিমান দু’টির। কিন্তু আকাশে মেঘের আস্তরণ পুরু থাকায় ধন্দে ছিলেন পাইলটরা। লক্ষ্যে আঘাত হানা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অগত্যা কোকুরা ছেড়ে দ্বিতীয় লক্ষ্য, নাগাসাকির দিকে রওনা দেয় যুদ্ধ বিমান দু’টি। সেখানেও মেঘের ঘনঘটার জন্য দৃশ্যমানতা কমে এসেছিল। কিন্তু নিয়তির সংযোগ কিনা জানা নেই, কয়েক মুহূর্তের জন্য সরে যায় মেঘ। একটি গোটা শহরকে ছিন্ন বিছিন্ন করে দেওয়ার জন্য ওই কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা বেজে ২ মিনিট। নাগাসাকির বুকে নেমে এল ‘ফ্যাট ম্যান’, মারণাস্ত্রের ওই নামই রেখেছিল আমেরিকা (US Nuclear Weapon)।   


 


৭৭ বছর আগে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল পরমাণু অভিশাপ


 


কী ভয়বহতা নেমে আসতে চলেছে পৃথিবীর বুকে, তা বোঝা গিয়েছিল এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে। চোখের পলক পড়ার আগেই ৪০ হাজার নিথর পড়ে থাকতে দেখা যায় নাগাসাকি শহরে। কিন্তু বোমা পড়ল, কিছু মরল, কিছু বাঁচল, একদিনে মেটার ছিল না এই ভয়াবহতা। পরবর্তী পাঁচ-ছ’মাস ধরে বোমার ক্ষত প্রাণ কেড়ে নেয় আরও ৩০ হাজার মানুষের। ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়র প্রভাবে প্রায় এক বছর ধরে প্রাণহানি ঘটে চলে সর্বত্র। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী কয়েক বছরে অন্তত ১ লক্ষ মানুষ মারা যান নাগাসাকিতে। বোমা যেখানে এসে পড়েছিল, সেই গ্রাউন্ড জিরো থেকে পার্শ্ববর্তী আড়াই কিলোমিটার পর্যন্ত ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধুলোয় মিশে যায়। বোমা এসে পড়র পর দিনই, ১০ অগাস্ট সম্রাটের ইচ্ছায় সায় দিয়ে মিত্রপক্ষের সামনে আত্মসমর্পণের ঘোষণা করে জাপান সরকার। নিঃশর্তে জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। তা নিয়ে দিন কয়েক ওঠাপড়া চলে। ১৫ অগাস্ট শেষমেশ রেডিওয় জাপানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা করেন সম্রাট হিরোহিতো।  


 


নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপের তিন দিন আগে, ৬ অগাস্ট হিরোশিমাতেও ‘লিটল বয়’ পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে আমেরিকা। তাতে মুহূর্তের মধ্য ৭০ হাজার মানুষ মারা যান। তার তেজস্ক্রিয় পদার্থের তীব্রতা এতটাই তীব্র ছিল যে পরবর্তী কয়েক বছর শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় হাজার হাজার শিশু। খাতায় কলমে সেই প্রথম বার পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগ চাক্ষুষ করে গোটা বিশ্ব। হিরোশিমা এবং নাসাকির হাত ধরেই পরমাণু অস্ত্রের যুগে প্রবেশ করে বিশ্ব। তবে হিরোশিমার তুলনায় নাগাসারি ভয়াবহতা কম আলোচিত। পুরনো ছবিতে চোখ রাখলে দেখা যায়, গোটা শহর কার্যত ধুলিসাৎ। প্রাণের চিহ্ন নেই কোথাও। শুধু গণকবর। সেই সময় তোলা ছবিতে একটি ছোট মেয়েকে দেখা যায়। বোমা বর্ষণের পর দু’টি চোখ কার্যত ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার। বিস্ফোরণের পর তীব্র আলোতে দৃষ্টিশক্তি হারায় মেয়েটি। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে, পরনের জামা-কাপড় ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকত দেখা যায় হাজার হাজার দেহ। এক মহিলার পরনের কিমোনোর নকশা গলে গায়ের উপর ছাপ বসে যায়। এমন বর্বরতা তার আগে পর্যন্ত চোখে পড়েনি।  


 


সেই সময় জাপানের এক সেনা আধিকারিক বলেছিলেন, ‘‘সামরিক বাহিনীর নিশানায় জাপানের সমগ্র জনসংখ্যা।’’ হিরোশিমায় যাঁরা প্রাণ হারান, তাঁদ‌ের মধ্যে ২৫০ জনেরও কম ছিলেন সৈনিক। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের উপযুক্ত জাপানের নাগরিকরা আগেই শহর ছেড়েছিলেন। অর্থাৎ জাপানের বয়স্ক নাগরিক, মহিলা এবং শিশুদের নিশানা করেই পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যুদ্ধের সমর্থেন অতি-বাস্তববাদীদের কখনও সখনও বলতে শোনা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন যে নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করুক না কেন, মানুষ হিসেবে যতই নীতি-আদর্শের বুলি কপচানো হোক না কেন, যুদ্ধ একটি নৃশংস ব্যবসা। জয় হাসিলের পথে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সার্বিক যুদ্ধের ব্যাখ্যায় এই রীতির কথা উঠে এসেছে ইতিহাসবিদদের লেখাতেও।


 


কিন্তু এই রীতি একপ্রকার বর্বরতাই। তাই আমেরিকার নাগরিক হোন বা অন্য কেউ, পরমাণু যুদ্ধের সমর্থনে যে তত্ত্বই খাড়া করা হোক না কেন, এই অপরাধের যুক্তিযুক্ত কারণ খোঁজা অর্থহীন। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের ৭০ বছর পর, ২০১৫ সালে পিউ রিসার্চ সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায়, আমেরিকার ৫৬ শতাংশ নাগরিক জাপানে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের সমর্থক। ১০ শতাংশ মনে মনে দ্বিধাবিভক্ত। বিগত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা বর্ষণের সমর্থনে নানা জনের মুখে নানা তত্ত্ব উঠে এসেছে। সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিধি-নিষেধ বলে কিছু হয় না, এমন ব্যাখ্যাও শোনা গিয়েছে। কেউ কেউ আমার সামরিক প্রয়োজনীয়তার দোহাই দিয়েছেন। জাপানকে আত্মসমর্পণ করানোর ক্ষেত্রে এ ছাড়া উপায় ছিল না বলেও, যুক্তি দিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথাই যদি ধরা হয়, পরমাণু বোমা কোথাও প্রাণ রক্ষা করেত সক্ষম হয়েছে কি, সদুত্তর দিতে পারেননি যুদ্ধের সমর্থকরা।


 


আরও পড়ুন:  জালিয়ানওয়ালাবাগ : ব্রিটিশ শাসন ও প্রায়শ্চিত্তের দিন


 


একজনের প্রাণের বিনিময়ে অন্যের প্রাণরক্ষা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মতামত রয়েছে। পরমাণু বোমা নিক্ষেপ না করে মুখোমুখি লড়াইয়ে জাপানকে আক্রমণের রাস্তাও হয়ত নিতে পারত আমেরিকা। কিন্তু আইওয়া জিমা যুদ্ধ দেখিয়েছে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মাতৃভূমি রক্ষায় প্রস্তুত জাপান। নারী এবং শিশুদের রক্ষা করতে হয়ত পিছু হটত না তারা। তাতে আমেরিকার কয়েক হাজার সেনা হয়ত মারা পড়ত যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকে বলেন যে, আমেরিকার সৈনিকরাও মানুষ। মিখোমুখই যুদ্ধে তাঁরা মারা পড়লে, জাপানের নাগরিকরাও বাদ যেতেন না। তাই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নৃশংস হলেও, দুই শহরে পরমাণু হামলা চালিয়ে একদিক থেকে জাপানের বহু নাগরিককে একদিক থেকে বাঁচিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্র্যুম্যান সাফ জানিয়েছিলেন, জাপানের নাগরিকদের প্রাণরক্ষার কথা মাথায় ছিলই না তাঁর। সেনাবাহিনী এবং ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টে যু্কত বিজ্ঞানীরাও তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেননি। বরং ট্র্যুমান বলেন, ‘‘ওরা (জাপান) একটি ভাষাই বোঝে, যে ভাষায় ওদের উপর বোমা নিক্ষেপ করেছি আমরা। দানবের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে, দানবীয় আচরণই কাম্য। তা নিয়ে আফশোস থাকলেও, সত্যকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।’’


 


তবে জাপানের নিরীহ নাগরিকদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ জার্মানির বিরুদ্ধে আমেরিকা বরাবর নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিল। সাধারণ জার্মান নাগরিক নয়, নাৎজি বাহিনীকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল তারা। জাপানের বিরুদ্ধে হামলার ক্ষেত্রে কিন্তু আমেরিকাকে সেই অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। জাপান সরকার বা সে দেশের সেনাবাহিনী নয়, সমগ্র জাপানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা, তাদের সেনা। এমনকি সে দেশের সাধারণ নাগরিকের মানসিকতাও ছিল একই রকম। সেই সময় আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় জাপানের নাগরিকদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক, জাতি বিদ্বেষমূলক কার্টুন, লেখা চোখে পড়ে। এমনকি আমেরিকার সরকারি নথিও ব্যাতিক্রম ছিল না। তাতে আমেরিকার সরকার এবং সমাজকে শ্রেষ্ঠতম হিসেবে দেখানোর নিদর্শন রয়েছে। আমেরিকার তৎকালীন ওয়ার ম্যানপাওয়ার কমিশনের চেয়ারম্যান পল ভি ম্যাকনাট বলেছিলেন, জাপানকে সম্পূর্ণ ভাবে নির্মূল করার পক্ষে ছিলেন তিনি। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের ছেলে এলিয়টও স্বীকার করেন যে, জাপানের জনসংখ্যার অর্ধেক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি।


 


তাই হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালিয়ে আমেরিকা যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছে বলা অন্যায় নয়। শুধু যুদ্ধাপরাধ নয়, সরকারি মদতে মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে এককথায় সন্ত্রাস চালিয়েছে তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে জাপান নিশ্চিত ভাবে হাত গুটিয়ে বসেছিল না। হানাহানি, বর্বরতা ঘটেছে তাদের হাতেও। কিন্তু পরমাণু হামলা চালানো যে অমানবিক আচরণ, তা অস্বীকারের উপায় নেই। কারণ আমেরিকার পরমাণু বোমা ব্যবহারই যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে বিগত কয়েক দশক ধরে জাগিয়ে রেখেছে। পরমাণু শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আজও ধ্বংসের খেলা আজ সার্বিক আকার ধারণ করেছে। মানব সভ্যতাকে আজ বিপদের পরমাণু বিপদের মুখে একদিক থেকে আমেরিকাই ঠেলে দিয়েছে, যেখানে জীবনের থেকে যুদ্ধে জয়লাভ অনেক বেশি মূল্যবান। জীবন এবং জীবনের অধিকারের প্রতি এই উদাসীনতা অনৈতিকতারই প্রমাণ দেয়। তাই হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারকে আধুনিক কালের আদিমতম অপরাধ হিসেবে গন্য করেত পারি আমরা।


 


নিজেদের প্রবল পরাক্রমশালী হিসেবে তুলে ধরতেই পরমাণু বোমা প্রয়োগ আমেরিকার!


 


শুধু তাই নয়, নাগাসাকির নৃশংসতা হিরোশিমাকেও ছাপিয়ে যায় বলা অনুচিত নয়। হিরোশিমার ভয়াবহতার পর দ্বিতীয় বার নাগাসাকিতে কেন পরমামু বোমা নিক্ষেপ করল আমেরিকা? জাপানের আত্মসমর্পণের জন্য কেন আর কিছু দিন অপেক্ষা করল না তারা? আমেরিকার সমর্থকদের যুক্তি, হিরোশিমা দেখার পরও জাপান আত্মসমর্পণ না করাতেই দ্বিতীয় বার বোমা নিক্ষেপ করা হয়। কারণ আমেরিকাকে চাপ তৈরি করে যেতেই হত। অনেকে আবার বলেন, আমেরিকার কাছে একটিই পরমাণু বোমা রয়েছে বলে ভেবেছিল জাপান। তা ছাড়া জাপানের সংস্কৃতির সঙ্গে সৈনিক মানসিকতা যে ভাবে জড়িয়ে, তাতে মানহানিকর আত্মসমর্পণের প্রশ্ন ছিল না। খেলনা থাকলে, কে না খেলতে চায়, আমেরিকার হয়ে এমন সওয়ালও করেন কেউ কেউ। কিন্তু জাপানকে আত্মসর্পণে বাধ্য করাই যে হামলার লক্ষ্য ছিল না, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আগেই। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয় আমেরিকা। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপের পর জাপান তখন ধুলোয় মিশে গিয়েছে। তাদের নিয়ে আর মাথাব্যথা ছিল না আমেরিকার। বরং জাপানকে সামনে রেখে, নিজেদের প্রবল পরাক্রমশালী হিসেবে তুলে ধরতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ক্ষমতার আস্ফালন শুরু করে দেয় তারা। তাই নাগাসাকির বিরুদ্ধে আমেরিকার অপরাধের হিসেব করা এখনও বাকি।