ইজরায়েলের উপর হামাসের হামলার পর ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে । আচমকা এই যুদ্ধ-আবহ আশ্চর্য করেছে গোটা বিশ্বকে। হামাসের হঠাৎ এই পদক্ষেপে একইসঙ্গে শোকাতুর ও ক্ষুব্ধ ইহুদি অধ্যুষিত রাষ্ট্রটি। ইজ়রায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জেনারেলরা প্রতিশোধের আঁচে ফুটছেন। কেউ কেউ হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। একইসঙ্গে গাজাকে সম্পূর্ণভাবে নবরূপে ইজরায়েলি আধিপত্যের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ারও। এই যুদ্ধ আবহে ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে, ১১০০-রও বেশি মানুষের। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ইজ়রায়েলের বাসিন্দা। যুদ্ধে প্যালেস্তাইনেরও কমপক্ষে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে এখনও পর্যন্ত। এই অস্থির এবং অস্বাভাবিক অবস্থার বিশ্লেষণ করার জন্য কেউ এগিয়ে আসার আগে, এর প্রতিক্রিয়া জানতে হবে, বহু বছর ধরে নিঃসন্দেহে যা অনুরণিত হবে পশ্চিম এশিয়া এবং তার বাইরেও। তার আগে অবশ্যই পরিষ্কার হয়ে নেওয়া দরকার, কীভাবে হামাসকে বিশেষ চারিত্রিক ছত্রছায়ায় ফেলা যেতে পারে।


ইজরায়েল, অ্যামেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ ইতিমধ্যেই হামাসকে ‘জঙ্গি সংগঠন’ আখ্যা দিয়েছে। তবে, জোর দিয়ে এটাও বলা যায়, গোটা বিশ্বের সবার মত এটা নয়। চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল, তুরস্কের মতো দেশ হামাসকে জঙ্গি সংগঠন বলে দেগে দেওয়ার বিষয়টিতে সংযত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৯৩ সদস্যের রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় হামাসকে জঙ্গি সংগঠন বলে ঘোষণা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ হয়।কিন্তু তা পাশ হয়নি। প্রস্তাবের পক্ষে ছিল ৮৭টি দেশ। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, এই কঠিন সময়ে ভারত ইজ়রায়েলের পাশে রয়েছে, ২০১৮ সালের ওই প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছিল ভারত সরকার।


হামাস। আরবিতে যার অর্থ ইসলামিক প্রতিরোধী আন্দোলন। আগে এই সংগঠন ছিল এক জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল। বর্তমানে এর জঙ্গি শাখাটির নাম আল-কাসাম ব্রিগেড (al-Qassam Brigades)। রয়েছে সামাজিক পরিষেবামূলক একটি শাখাও। নাম দাওয়া (Dawah)। তবে হামাসের পশ্চিমি সংস্করণে যা প্রায় সর্বদা উপেক্ষিত, তা হল, রাজনৈতিক দল হিসেবে এর কার্যকরী অস্তিত্ব। ২০০৬ সালে প্যালেস্তাইনে লেজিসলেটিভ ইলেকশনে অংশগ্রহণও করেছিল হামাস। ওই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যাতে প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের পক্ষে যায়, তার জন্য মরিয়া চেষ্টা চলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইজরায়েলের তরফ থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও পরিদর্শক মহলের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, নির্বাচনটি প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে জয়লাভ করে হামাস। ফতে-কে তারা হারায় ৭৬-৪৩ ব্যবধানে। হামাস পরিচালিত সরকারের প্রতি সবরকম আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় অ্যামেরিকা, কানাডা। পরে একইপথে হাঁটে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। এই সিদ্ধান্ত শুধু যে হামাসের সঙ্গেই নাশকতা তা নয়, সার্বিকভাবে প্যালিস্তিনীয়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই পদক্ষেপ। অদ্যবধি, প্যালেস্তাইনের ন্যাশনাল অথরিটি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হামাসেরই।


ইজরায়েলের উপর রক্তাক্ত ও প্রাণঘাতী যে হামলা হামাস চালিয়েছে, তার প্রেক্ষিতে পশ্চিমি দুনিয়া যেভাবে সরব তাতে করে এই ইতিহাস যে ইদানিং অস্পষ্ট তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চিতভাবে, যেভাবে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে ও ভয়াবহভাবে হত্যা করেছে হামাস, তাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে গোটা বিশ্বের নজরে পড়ার মতো কিছু করেনি তারা। রাজনৈতিক দল হিসেবে আলোচনার টেবিলে বসার মতোও কিছু নয়। ২৫০-রও বেশি ইজরায়েলের বাসিন্দাকে একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যাল চলাকালীন খুন করা হয়েছে। তাঁরা বুঝতেও পারেননি, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণঘাতী হামলার শিকার হবেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের হত্যা, তা সে পুরুষ হোক বা মহিলা, শিশু হোক বা বয়স্ক, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করতে হবে। একইভাবে, পণবন্দি করাকে সভ্য সমাজের সমস্ত রীতি-নীতির তীব্র বিরোধী হিসেবেও কঠোর নিন্দা করা জরুরি।


দুটি প্রশ্ন


ইজ়রায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু যেমন ঘোষণা করেছেন, সেই মোতাবেক, এই ‘যুদ্ধ’ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তার ফলে কী হবে, তা কারোরই জানা নেই। 


বর্তমান বিতর্ক যা নিয়ে সেরকম একাধিক বিবেচনা বা প্রশ্নের মধ্যে দুটিই আপাতত যথেষ্ট। প্রথম কঠিন প্রশ্নটি আরও অনেকের। ইজ়রায়েলকে হতচকিত করে কীভাবে জল, স্থল এবং আকাশপথে কীভাবে এরকম পূর্ণাঙ্গ ও পরিকল্পিত হামলা চালাল হামাস ? গুরুত্বহীন না হলেও এই প্রশ্নটি, যেমনটি মনে করা হয়, তার থেকে কম আকর্ষক।


অত্যাধুনিক সমরসজ্জা শোভিত রাষ্ট্র ইজরায়েল। বজ্রকঠিন, বাস্তববাদী রাষ্ট্র। নজরদারি প্রযুক্তিতে বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য দেশ। ছোট্ট কিন্তু সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। পাশাপাশি, রয়েছে অসংখ্য সংরক্ষিত সেনা, যা গোটা বিশ্বের কাছেই ঈর্ষার কারণ। দ্য গার্ডিয়ানে পিটার বিমন্ট লিখেছেন, “… ইজরায়েলে আচমকা এই হামলা তদন্তকারী সংস্থাগুলির ব্যর্থতার নজির হিসেবে স্মরণে থেকে যাবে বহুদিন…”। তিনি অন্যদের মতো এও মনে করিয়েছেন, পেগাসাস স্পাইওয়্যারের আবিষ্কর্তা ইজ়রায়েল এবং দেশের সাইবার ইউনিট ৮২০০ ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সে (IDF)-এ এই মুহূর্তে সর্ববৃহৎ ইউনিট।


অসাধারণ নিরাপত্তা নৈপুণ্য থাকা সত্ত্বেও, সম্ভবত, হামাসের আচমকা হামলা ও অনুপ্রবেশ রুখতে সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত ছিল ইজ়রায়েল। এমনকি হামাসের তীব্র সমালোচক, সন্দেহভাজনও গোপনে তাদের চাতুর্যে অবাক হবে এই ভেবে কীভাবে তারা হাজার হাজার রকেট ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে ছুড়েছে, ডোম আকাশপথে হামলা প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে পরাস্ত করেছে, ইজরায়েল-গাজা সীমান্তে তারের বেড়ার একাংশকে বুলডোজারের সাহায্যে নষ্ট করেছে, এবং উল্লেখযোগ্যভাবে প্যারাগ্লাইডারের সাহায্যে হামাস সদস্যদের ইজরায়েলের মাটিতে হামলা করতে পাঠিয়েছে। ইজরায়েল এবং অ্যামেরিকার গোয়েন্দারা এই ধরণের হামলার কোনও পূর্বাভাস পাননি বা আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি। যা ইজরায়েলের গর্বকেও খর্ব করেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার জেরে উদ্ভুত ক্ষোভ-বিক্ষোভে এমনিতেই বছরখানেক ধরে ভুগছে ইজরায়েল।  সঙ্গে রয়েছে, র্যাগট্যাগ যোদ্ধা সহ হামাসকে  অত্যধিক ব্যয়বহুল সংগঠন হিসেবে চোখের সামনে আনা।


এসবের মধ্যে যেটা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, এবং যা অনিবার্য, তা হল বিশ্বের কোথাও কোনওদিন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না। আজও নেই। তবে প্রকৃত বাস্তব রাজনৈতিক মত মেনে চলেন যাঁরা, তাঁদের কাছে এটা একপ্রকার ভ্রমই। পাশাপাশি, স্বাধীনতা অর্জনে উন্মুখ, খাঁচায় থাকতে, বদ্ধ জীবনযাপনে নারাজ যাঁরা, তাঁদের কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাহায্যেই আটকে রাখা যায় না। গাজা স্ট্রিপ ঠিক তেমনই - একটি খাঁচা, যেখানে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ কার্যত বন্দি, যখন ২০০৭ থেকে ইজরায়েল তাদের উপর আইনহীন এক অবরোধ জারি করে রেখেছে। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি যে হামাসকে সমর্থন করে তা নয়। কিন্তু এমন একজন ফিলিস্তিনিও নেই, যে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায় না। কিন্তু পশ্চিমি ভাষ্যকারদের আলোকসম্পাত থেকে যা অনেক দূরে। যেমন থমাস ফ্রিডম্যান, হামাস কেন ইজরায়েলের উপর হামলা চালাল, তা নিয়ে এই মুহূর্তে তাঁর একমাত্র ব্যাখ্যা সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ বই কিছু নয়। ব্যাখ্যাটি হল, সৌদি আরব  ও অ্যামেরিকার মধ্যে তিক্ততা পরবর্তী সম্প্রীতি বিঘ্ন করতে ইচ্ছাকৃত ষড়যন্ত্র সাধন হামাসের লক্ষ্য। এবং ইজরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন। হামাসের মাথাতেও এটি ছিল না ভাবলে ভুল হবে। তবে তার থেকেও বেশি ভাবনায়, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, সুবিচার, মর্যাদার জন্য আকাঙ্খা।


 


 



লেখক ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস এঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) এর ইতিহাস ও এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজের অধ্যাপক।


ডিসক্লেমার… লেখাটি , মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত এবং এবিপি নেটওয়ার্কের মতামত, বিশ্বাসের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই।