সদগুরু: আজকে সমাজ যত আধুনিক হয়ে উঠছে, ততই আমাদের সংস্কৃতিগুলো সম্পূর্ণ দেহকেন্দ্রিক (body culture) হয়ে উঠছে। দেহই প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে। আমাদের বিবর্তন যত এগোয় ততই অন্য অংশগুলোর গুরুত্ব বেড়ে ওঠা উচিত। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যবশত, দেহই বাকি সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেহই সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। সমাজ যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলছে আর যেভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের মানসিকতা গড়ে তুলছি তাতে এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনও পুরুষ বা নারীকে দেখলেই আপনি তাঁদের দৈহিক সুখ লাভের এক মাধ্যমমাত্র হিসাবেই দেখছেন। এই নিরিখে সমাজ চরম এক অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে। 


আমি চাই মানুষ নিজেদের “মানুষ বা মানব সত্ত্বা” হিসাবেই দেখুক, পুরুষ বা নারী হিসাবে নয়। জীবনের কিছু বিশেষ সময়েই আপনার একজন পুরুষ বা নারীর ভূমিকা পালন করার দরকার হয়। যৌনতা আপনার একটা ক্ষুদ্র অংশমাত্রই। আপনি যদি জীবনকে সেটা ঠিক যেমন তেমনভাবেই দেখেন, তাহলে যৌনতা ঠিক নিজের জায়গা মতো জায়গায় থিতু হয়ে যাবে। জায়গাটা আপনার জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশই। এটা এতো বড় আকার নেবে না। এরকমই হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি জীবের ক্ষেত্রেই তাই। পশুরা কিন্তু সব সময় এটা নিয়ে ভাবে না। তাদের মধ্যে এটা যখন আসার তখন আসে। তা নাহলে তারা কিন্তু কে পুরুষ আর কে মহিলা তা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভেবে চলে না। একমাত্র মানুষেরাই এই নিয়ে আটকে থেকে যায়। 


আপনি যেটাকে পরুষ বা নারী বলছেন সেটা শুধুই একটা শারীরিক পার্থক্যের বিষয় যার উদ্দেশ্য প্রকৃতির এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকে নিস্পত্তি দেওয়া। আপনার লিঙ্গ কী, তা রাস্তাঘাটে সর্বক্ষণ আপনাকে মাথায় রেখে চলতে হবে না। আপনার পরিচয় যদি আপনার শরীরের কয়েকটা অঙ্গমাত্রই হয়, আপনার সঙ্গে সবাই সেই মতই ব্যবহার করে। আমরা দেহের একটা অঙ্গের সাথে এতো বেশি গুরুত্ব জুড়ে দিয়েছি কেন? দেহের কোনও অঙ্গেরই এতো বেশি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যতা নেই। কোনও অঙ্গের এই ধরনের গুরুত্ব পাওয়ার থাকলে,  হয়ত মস্তিষ্ককে যোগ্য বলা করা যেতে পারে, আপনার যৌনাঙ্গ নয়। তাই দিনে 24 ঘন্টা ধরে একজন পুরুষ বা একজন মহিলার ভূমিকা পালন করার দরকার নেই। কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আপনাকে সেই ভূমিকা পালন করতে হয়। বাকি সময়ে আপনার পুরুষ হওয়ারও দরকার নেই, মহিলা হওয়ারও দরকার নেই। আপনি একজন পুরুষ বা মহিলা হয়েই থেকে গেলে, কোনও দিনও মুক্ত হবেন না।    


মূলত জীবনের ভৌত দিকগুলোর উপর অতিরিক্ত বিনিয়োগ করাই হল সমস্যার মূল। আপনি ভাবেন এই দেহের পরিসরটাই চূড়ান্ত। যে মুহূর্তে আপনার দেহের সীমানা, আপনার জীবনের চূড়ান্ত সীমানা হয়ে ওঠে, তখন আপনি নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস যা মূলভূতরূপে আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আপনি সেটাকেও অনুভব করেন না। 


যেখানেই সমাজ অধ্যাত্মমুখী হয়েছিল, সেখানে সেখানে পুরুষ বা মহিলা হওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না, কারণ পুরুষ বা নারী হওয়াটা মূলত জড়-ভৌত ব্যাপার। আধাত্মিকতা ঠিক বা ভুলের ব্যাপার নয়, ভগবান বা স্বর্গের ব্যাপারেও নয়। আধ্যাত্মিক হওয়া মানে আপনাকে কিছু বিশ্বাস করতে হবে, বা কোনও দর্শন মানতে হবে বা সেরকম কিছু নয়। গোটা আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হল জড়-ভৌতকে অতিক্রম করে বেড়ে ওঠা। আপনার জীবনের অনুভূতি যদি ভৌত জগতের সীমা পেরিয়ে যায়, তখন আমরা বলি আপনি আধ্যাত্মিক। ভৌত অস্তিত্বের বাইরের কিছু যদি আপনার অন্তরে জীবন্ত বাস্তব হয়ে ওঠে, তখন নিজের ভৌতিকতাকে আপনি অত্যন্ত অনায়াসে সামলাতে পারেন।  


যতক্ষণ কেউ নিজেকে ভৌত শরীর বলে ভাবে, ততক্ষণ বন্ধন মুক্ত হওয়া অসম্ভব। মানুষ যখন নিজেকে ভৌত শরীরের অতিরিক্ত কিছু বলে অনুভব করতে শুরু করে, শুধুমাত্র তখনই স্বাধীনতা থাকতে পারে। আপনি পুরুষ হন বা মহিলা, আপনাকে আপনার ভৌত শরীরের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আত্মপলব্ধিতে সাহায্য করাই হল সমগ্র আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া ও গোটা যোগবিজ্ঞানের লক্ষ্য। স্বাধীনতা সেখানেই। যৌনতা থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে কেউ স্বাধীনতা লাভ করবে না। শুধুমাত্র যদি নিজের “লিঙ্গ” থেকে মুক্ত হন, তবেই আপনি স্বাধীন। 


সদগুরু একজন যোগী, অতীন্দ্রিয়বাদী এবং নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলিং লেখক। তিনি ভারতবর্ষের প্রথম ৫০ জন প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে একজন। ২০১৭ সালে ভারত সরকার সদগুরুকে ব্যতিক্রমী এবং বিশিষ্ট সেবার জন্য ভারতের সর্বোচ্চ বার্ষিক বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণ-অভিযান, কনশাস প্ল্যানেট – সেভ সয়েল (Conscious Planet - SaveSoil)-এর প্রতিষ্ঠাতা, যা পৃথিবী জুড়ে ৩৯০ কোটিরও বেশি মানুষকে স্পর্শ করেছে।


বিঃদ্রঃ - প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়