সদগুরু বলেন, “আমার উদ্দেশ্য হল, যারা তাদের জীবনটাই কৃষিকাজের জন্য দিয়ে দিয়েছেন, তারা যেন অন্তত ততটাই আয় করেন যতটা একজন ডাক্তার, একজন উকিল অথবা কোনও ইঞ্জিনিয়ার শহরে থেকে আয় করেন। তা নাহলে আগামী ২৫-৩০ বছর সময়ে কেউই আর চাষবাস করবে না।“
সদগুরু: অক্ষাংশগত বিস্তারের ফলে আবহাওয়া, মাটি, জলবায়ুগত অবস্থার বৈচিত্র্য থাকায় এবং সর্বোপরি “মাটিকে খাদ্যে রূপান্তরিত করার যে জাদু” তার সহজাত জ্ঞান এক বিপুল জনসংখ্যার কাছে থাকার দরুন, আমাদের দেশ গোটা বিশ্বের “অন্নদাতা” হয়ে ওঠার ক্ষমতায় আশীর্বাদধন্য।
দুর্ভাগ্যবশত, যে কৃষক আমাদের খাদ্যের জোগান দেন, তাঁর নিজের সন্তানরাই অভুক্ত এবং তিনি নিজে আত্মহত্যা করতে চান। আমরা যে কয়েকটি প্রাথমিক সমীক্ষা করেছিলাম, তা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, কৃষি-সম্প্রদায়ের ২ শতাংশও চান না যে তাঁদের সন্তানেরা কৃষিকাজ করুক। আর ২৫ বছরের মধ্যে, যখন এই প্রজন্মটা চলে যাবে, তখন কে আমাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করবে? যদি এই দেশে কৃষিকাজকে টিকতে হয়, তাহলে আপনাকে কৃষিকাজকে লাভজনক করে তুলতে হবে।
এই পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল প্রসার বা আওতা – কৃষকদের জমিগুলো খুবই ছোট। এই মুহূর্তে, জমির গড় আকার হল এক হেক্টর, অথবা ২.৫ হেক্টর, যা দিয়ে আপনি উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারবেন না। মূল যে দুটো কারণ কৃষকদের দারিদ্র এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেই দুটো হল ‘জলসেচে বিনিয়োগ’ এবং ‘বাজারমূল্য নিয়ে দরাদরি বা মধ্যস্থতা করতে না পারা’। প্রসার বা আওতা না থাকলে এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হাতের বাইরেই থেকে যায়।
এই মুহূর্তে আমরা “ভেল্লিয়ানগিরি উজহাবান” নামক এক কৃষি উৎপাদক সংস্থা (FPO)-এর সহায়তা করছি, যা দেশের সফলতম কৃষি উৎপাদক সংস্থাগুলোর একটি। এই কৃষি উৎপাদক সংস্থাটি প্রায় ১৪০০ জন মতো কৃষককে একত্রিত করেছে এবং তাদের আয় বহুগুণে বেড়ে গেছে।
আমরা এই কৃষি উৎপাদক সংস্থাটি (FPO) শুরু করার সম্ভবত চার বছর আগেকার কথা। তখন একজন সুপারি ব্যবসায়ী তার লরি নিয়ে গ্রামে এসেছিলেন। যখন তিনি আসতেন, তখন একজন ছোট চাষি যার সুপারির একটা ছোট ঢিপি ছিল অর্থাৎ উৎপাদন কম, তাকে তিনি এক কিলোগ্রাম পিছু ২৪ টাকা মূল্য দিতেন, আরও বড় উৎপাদন সম্পন্ন একজন মাঝারি স্তরের চাষিকে দিতেন এক কিলো পিছু ৪২ টাকা, এবং প্রচুর উৎপাদন সম্পন্ন একজন বড় চাষিকে দিতেন কিলো প্রতি ৫৬ টাকা -একই দিনে, একই সুপারির জন্য। ছোট চাষিটি দর করার চেষ্টা করলে তারা, “আচ্ছা, রাখুন আপনার ফসল,” বলে হেটে চলে যেতেন। ছোট চাষিটির কাছে তার ফসল বিক্রি করার কোনও উপায়ই থাকত না। নিজের ফসল ক্ষেত থেকে বয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে অনেক বেশি খরচ হয়, এবং সমস্ত ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে চুক্তিবদ্ধ করে থাকতেন, যাতে কেউই ওই চাষির থেকে না কেনে।
তাই একবার যেই কৃষি উৎপাদক সংস্থাটি গড়ে উঠল, তখন আমরা সকলের উৎপাদনকে এক জায়গায় করলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা গড়ে কিলো প্রতি ৭২ টাকা, ৭৩ টাকা করে পেতে শুরু করলেন। এটা তাদের জীবন বদলে দিয়েছিল। তারপর আমরা সমস্ত কৃষিজ উপাদান যেমন বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির জন্য একটা দোকান খুলেছিলাম। ডিলার বা বিক্রেতারা যে ন্যূনতম ৩০% লাভ নিতেন, তা সোজা চলে গেল চাষিদের কাছে। যার মানে (কাঁচামালের) খরচে ৩০ শতাংশ হ্রাস। আরেকটা যে ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম তা হল, সুপারি গাছ বেয়ে উঠে সুপারি পেরে আনার মানুষের জোগাড় করা। আপনি যে-কোনও শ্রমিককে উপরে উঠতে বলতে পারেন না, ওরা নিজেদের মেরে ফেলবে। এর জন্য দক্ষতা রাখেন এমন মানুষদের একটা দল আমরা তৈরি করলাম এবং তারা কখন প্রতিটা খামারে যাবেন তার একটা সময়সূচি তৈরি করেছিলাম। (ফলে) এখন আর তাদের খোঁজে কৃষকদের তাদের পিছু পিছু ধাওয়া করতে হয় না। সেই রোজকার সার্কাস এখন আর নেই।
কৃষিকাজের মূল ভিত-গুলোকে পরিবর্তন করার চাবিকাঠি
সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা চায় দেশ জুড়ে ১০,০০০ টি কৃষি উৎপাদক সংস্থা (FPO) তৈরি হোক। ১০,০০০ টি এফ.পি.ও. হওয়া ভাল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল একটা এফ.পি.ও-তে যেন (অন্তত) ১০,০০০ জন চাষি থাকেন এবং তাদের সব জমি যেন একত্রে একটাই বড় নিরবচ্ছিন্ন জমি হয়। তা নাহলে, আমরা মার্কেটিং এবং কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে কিছু চালাকি করতেই পারি কিন্তু মূল ভিত্তিগত কোনও পরিবর্তন আনতে পারি না। কেন?
এই মুহূর্তে, দুটি কারণ আছে যার জন্যে চাষিরা তাদের জমিতে প্রতিদিন টহল দিতে যান। একটা কারণ হল, তারাই যে (উক্ত জমির) মালিক সেটা প্রমান করতে। নচেৎ, কেউ একজন সীমানার পাথরগুলো একটু সরিয়ে দিয়ে ওনার জমিতেই লাঙ্গল চালাবেন। অন্য কারণটা হল, ইলেকট্রিক পাম্পটা চালু করতে এবং জলসেচের জন্য সুইচটা বন্ধ করতে।
যদি আমাদের একটাই নিরবিচ্ছিন্ন জমি অর্থাৎ সমস্ত লাগোয়া জমিকে একসাথে পাই, তাহলে অনেক কোম্পানি আছে যারা একটা ডিজিটাল সার্ভে করে স্যাটেলাইট মারফত একবারে চিরকালের জন্য জমির সীমানা ঠিক করে দিতে পারেন। (এতে) জমিতে কোনও দাগ বা চিহ্ন রাখার দরকার হয় না এবং কেউ সেটা বদলাতেও পারে না। একবার এমনটা করে ফেললে, ওটা যে তারই জমি সেটা প্রমান করতে চাষিকে ক্ষেতে রোজ যেতে হবে না। এর পরে যেটা করতে পারি, তা হল ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচার বা সমন্বিত কৃষিকাজ। এই মুহূর্তে প্রতি ২ - ৫ একরে, একটা করে কুয়ো, একটা করে বিদ্যুতের সংযোগ এবং কাঁটাতারের বেড়া থাকে। এটা সম্পদের ভয়ংকর অপচয়। আমরা যদি ১০,০০০-১৫,০০০ একর জমি একত্রে পাই, তাহলে অনেক বিচক্ষণতার সঙ্গে জলসেচ করতে পারা যায়। বহু ড্রিপ ইরিগেশন বা বিন্দু সেচের কোম্পানি আছে যারা তাদের পরিষেবা এমনকি মাসিক ভাড়া বাবদও দিতে ইচ্ছুক। এর অর্থ হল, চাষিকে কিছু বিনিয়োগ করতে হবে না, এবং জলকে শয়ে শয়ে কুয়ো থেকে বের করতে হবে না। হয়ত ১০-২৫ টা কুয়ো গোটা জায়গাটাতে জলসেচ করে দিতে পারে।
একজন চাষিকে প্রতিদিন তার জমিতে, সেটা যে তার জমি, তা প্রমাণ করতে ও জলের পাম্পটা চালু করতে যেতে হবে না – আমরা যদি এই দুটি জিনিস সামলে ফেলতে পারি, তাহলে চাষিরা তাদের জমিতে কার্যকরীভাবে ফসল ফলাতে বছরে মাত্র ৬০-৬৫ দিনে একবার যেতে পারেন। এই দেশের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের হাত অন্ততপক্ষে ৩০০ দিনের জন্য ফাঁকা হয়ে যাবে। কাজেই বিষ্ময়কর পরিমাণ আনুষঙ্গিক শিল্প সম্ভব।
নানা ভাবে, ভেল্লিয়ানগিরি উজহাবান-এর কৃষি পরিবারের মহিলা সদস্যদের হাত যথেষ্ট পরিমানে কাজ কমে গিয়েছিলো কারণ অযথা গ্রামে যাওয়া ও বিভিন্ন জিনিস সামালানোটা কমে এসেছিল। তাই নিজে থেকেই, এই সকল মহিলারা একত্রিত হয়েছিলেন এবং মশলা তৈরি করা শুরু করেছিলেন। সেই মশলার ব্যবসার মূল্য আজকে তাদের কৃষিজ উৎপাদনের প্রায় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার উদ্দেশ্য হল, যারা তাদের জীবনটাই কৃষিকাজের জন্য দিয়ে দিয়েছেন, তারা যেন অন্তত ততটাই আয় করেন যতটা একজন ডাক্তার, একজন উকিল অথবা কোনও ইঞ্জিনিয়ার শহরে থেকে আয় করেন। তা নাহলে আগামী ২৫-৩০ বছর সময়ে কেউই আর চাষবাস করবে না।
এই মুহূর্তে আমরা হলাম পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। আমরা সহজেই এই জমি থেকে পৃথিবীর আরও ১০-৪০ শতাংশ মানুষকে খাওয়াতে পারি। এর ততটাই ক্ষমতা রয়েছে। আমরা সেই ক্ষমতাকে আদৌ পরখ করে দেখব কি না, সেটাই হল বড় প্রশ্ন, কিন্তু কৃষি উৎপাদক সংস্থা(FPO) অবশ্যই সেই সম্ভাবনাটাই তৈরি করে দেয়।
যোগী, অতীন্দ্রিয়বাদী, দিব্যদর্শী এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বেস্ট সেলিং (সর্বাধিক বিকৃত বইয়ের) লেখক সদগুরু ভারতের পঞ্চাশ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। অসাধারণ ও বিশিষ্ট পরিষেবার জন্য তিনি ২০১৭ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পদ্ম বিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন যা ভারতের সর্বোচ্চ বার্ষিক অসামরিক পুরস্কার। তিনি, Conscious Planet -মাটিকে বাঁচান (কনশাস প্ল্যানেট বা সচেতন পৃথিবী) নামক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জন-অভিযানের প্রবর্তক যা ৩৯০ কোটিরও বেশি মানুষকে স্পর্শ করেছে।
বি : দ্র : প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়