ভার্চুয়াল দুনিয়ার চৌকাঠে পা পড়ার আগে পর্যন্ত সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির মোটামুটি একটা সংযোগ ছিল। সেই সংযোগ নিবিড় না হলেও, পত্র-পত্রিকা, শারদীয়া সংখ্যার বিক্রি ছিল ভালই। আর তার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালিকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব ঢের আগেই নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি, ’বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক তিনি। ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘আনন্দমঠ’-সহ ১৪টি উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিম। এর বাইরে লিখেছেন গদ্য, গীতার ব্যাখ্যাও বেরিয়েছে তাঁর কলম থেকে। সাহিত্য সমালোচকের ভূমিকাও পালন করেছেন। বাংলার শিক্ষাপ্রেমী মানুষের কাছে তাই ‘সাহিত্যসম্রাট’ তিনি। (Bankim Chandra Chatterjee Birth Anniversary)
কিন্তু আজকের দিনে বঙ্কিম শুধুমাত্র উপমাসর্বস্ব হয়ে রয়ে গিয়েছেন বললে ভুল হয় না। বাংলা ভাষা শেখার অনীহা, পাঠকের কাছে অপাঠ্য করে রেখেছে তাঁর রচনা। বঙ্কিম এবং তাঁর রচনা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাঁর রচনাকে দেখা, তৎকালীন সমাজব্যবস্থা বঙ্কিমের লেখাকে কতটা প্রভাবিত করেছিল, বঙ্কিমই বা নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কতটা প্রভাবিত করেছিলেন সমাজজীবনকে, তা নিয়ে গবেষণায় রয়েছে ঔদাসীন্য। তাই বঙ্কিমকে নিয়ে চিরাচরিত সেই ধারণাগুলিই রয়েছে, ১) তাঁর লেখা অত্যন্ত কঠিন, ২) সনাতনী ভাবনা এবং ৩) দ্বিজাতি তত্ত্বনির্ভর। তাই আজ বলে নয়, বরাবরই বাংলা সাহিত্য তথা বাঙালির সমাজজীবনে বঙ্কিমরচনা বিতর্কের উদ্রেক করে, স্বাধীনতার আগে এবং পরেও। (Bankim Chandra Chatterjee)
জীবনের মাত্র ৫৫টি বসন্ত দেখার সুযোগ হয়েছিল। তবে প্রাপ্তিতে কোনও খামতি নেই, না যশ, খ্যাতির, না সমালোচনার। এর নেপথ্যে বার বার বঙ্কিমের যে দু’টি সৃষ্টির কথা প্রথমেই উঠে আসে, তা হল ‘আনন্দমঠ’ এবং ‘রাজসিংহ’। প্রথমটির কাহিনী বোনা হয়েছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহেকে প্রেক্ষাপট করে। দ্বিতীয়টিকে বঙ্কিম নিজে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে দাবি করেছিলেন, যার বিষয় ছিল মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব বনাম রাজপুত গৌরবের গাথা। কিন্তু এই দু’টি উপন্যাসকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে বিস্তর।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটির গুরুত্বের কথা বার বার উঠলেও, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেপথ্যে এই উপন্যাসটিই একপ্রকারে দেশলাইয়ের কাজ করেছিল বলে মনে করেন সমালোচকদের একাংশ। উপন্যাসে যেভাবে মুসলিমদের বার বার ‘নেড়ে’, ‘যবন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলিমদের বাদ দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা কোনও রকম রাখঢাক না করেই বলা হয়েছে, তাতে ব্যক্তি বঙ্কিমের সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবনাই পরিস্ফূটিত হয়েছে বলে মত অনেকের।
এ প্রসঙ্গে বার বার ‘আনন্দমঠ’-এর বেশ কিছু অংশের উল্লেখ উঠে আসে, যেখানে মহেন্দ্রকে দীক্ষা দেওয়ার আগে সত্যানন্দ বলেন, ‘আমরা রাজ্য চাহি না-কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিধন করিতে চাই’।
আবার উপন্যাসের এক জায়গায় মহেন্দ্র এবং ভবানন্দের কথোপকথন এইরূপ-
মহে-তবে ইংরেজ মুসলমান এত তফাৎ কেন?
ভবা- ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায়-শরবত খুঁজিয়া বেড়ায়-ধর, তারপর ইংরেজদের জিদ আছে-যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকাড়ি। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহিরা মাহিয়ানা পায় না। তারপর শেষ কথা সাহস-কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না-সুতরাং এক গোলা দেখে দুইশো জন পলাইবার দরকার নেই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীসুদ্ধ পলায়-আর গোষ্ঠীসুদ্ধ গোলা দেখিলে তো একটা ইংরেজ পলায় না।
উপন্যাসের শেষ অংশে সত্যানন্দ এবং মহাপুরুষের কথোপথকনে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তাঁদের কথোপকথন আবার এই রূপ-
সত্য-মুসলমানরাজ্য ধ্বং হইয়াছে, কিন্তু হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হয় নাই-এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।
তিনি-হিন্দুরাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না-তুমি থাকিলে এখন অনর্থক নরহত্য়া হইবে। অতএব চলো।
শুনিয়া সত্যানন্দ মর্মপীড়ায় কারত হইলেন। বলিলেন, ‘হে প্রভু! যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে’।
তিনি বলিলেন, ‘না, এখন ইংরেজ রাজা হইবে’।
‘আনন্দমঠ’ জুড়ে একাধিক বার মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম, তাদের বাড়িঘর লুঠ, পুড়িয়ে উল্লাস দেখান চরিত্ররা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান লেখেন, ‘এতে এমন এক দেশাত্মবোধের কথা বলা হল, যা ভারতীয় মুসলমানের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। ফলে, না তারা দেবীবন্দনা করতে পারলেন, না মুসলমানবিদ্বেষী কথা অগ্রাহ্য করতে পারলেন। এই রাষ্ট্রচেতনা, কোনও সন্দেহ নেই, সম্পূর্ণই হিন্দুরাষ্ট্রবাদ’। ইতিহাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যেকার বোঝাপড়া, একজোট হয়ে ইংরেজ শাসকের বিরোধিতার উল্লেখ মেলে। কিন্তু ‘আনন্দমঠ’ থেকে বঙ্কিম সচেতন ভাবেই ফকিরদের বাদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
একই অভিযোগ ওঠে ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসটি নিয়েও। সেখানেও মুসলিমদের বার বার ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’ এবং ‘নেড়ে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের গালি দিতে ব্যবহার করা হয়েছে, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, নরাধম, অকৃতজ্ঞ, ইতরের মতো শব্দের। ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে বঙ্কিম লেখেন, ‘ঔরঙ্গজেব মহাপাপিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধূর্ত্ত, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর, পরপীড়ক, প্রজাপীড়ক দুই একজন মাত্র পাওয়া যায়। এই কপটাচারী সম্রাট জিতেন্দ্রিয়তার ভাণ করিতেন-কিন্তু অন্তঃপুর অসংখ্য সুন্দরীরাজিতে মধুমক্ষিকাপরিপূর্ণ মধুচক্রের ন্যায় দিবারাত্র আনন্দধ্বনিতে ধ্বনিত হইত। তাঁহার মহিষীও অসংখ্য’।
‘রাজসিংহ’কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলেই উল্লেখ করেন বঙ্কিম। যদিও ইতিহাস বলছে, মোগল সম্রাট তো বটেই হিন্দু রাজাদের মধ্যেও বহুবিবাহ এবং বিবাহের বাইরে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার চল ছিল। কিন্তু ‘দিল্লির বাদশাহেরা মুসলমান হইয়াও অত্যন্ত মদ্যাসক্ত ছিলেন’ বলে যে কথা লিখেছেন বঙ্কিম, তাঁর চরিত্রের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে খাপ খায় না বলে মত সমালোচকদের। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে যোধপুরী বেগমের চরিত্রটির মাধ্যমে মুসলিম ঘরে হিন্দু নারীর বিবাহ হলে কী ঘটে, তা নিজের মতো করে তুলে ধরেন বঙ্কিম, যা আজকের দিনের ‘লভ জিহাদ’ তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায়।
সমালোচকদের একাংশের মতে, বঙ্কিম আসলে তৎকালীন বঙ্গসমাজের হিন্দু অভিজাতদের অভিমতকেই তুলে ধরেছিলেন নিজের লেখায়, মুসলিম শাসকদের পরাভূত করতে যাঁরা অত্যাচারী ইংরেজ শাসককে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ওই অভিজাতরা একদিকে যেমন মুসলিম শাসকদের ঘৃণা করতেন, তেমনই নাগরিক হিসেবে সমাজে সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে ক্ষুব্ধ ছিলেন তাঁরা। তাই ইংরেজ এলে মুসলিম বিদেয় হবে বলেই মত ছিল তাঁদের। ‘দেবী চৌধুরীণী’ উপন্যাসে সেই চিন্তারই ঝলক মেলে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ দানেশ খাঁ-কে মুসলিমদের ‘শুয়ার’বলতে দেখা গিয়েছে। ‘মৃণালিনী’তে বখতিয়ার খিলজিকে ‘অরণ্য নর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কবিতা পুস্তক’-এ বঙ্কিম লেখেন, ‘আসে আসুক না আরবী বানর- আসে আসুক না পারসী পামর’।
তাই ‘দ্য অটোগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ বইয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেন বঙ্কিমকে। তাঁর কথায়, বঙ্কিম ছিলেন ‘ধর্মী সংস্কৃতির অন্যতম প্রচারক’। নীরদচন্দ্রের কথায়, ‘(১৯) শতকের শেষ দিকে হিন্দু সংস্কার সনাতনী ফাঁদে আটকে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিও সেই সংক্রমণ এড়াতে পারেননি। পরিশীলিত রূপ দিয়ে নিজের লেখায় সেই ভাবনা চালান করে দিয়েছিলেন তিনি।’।
‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে প্রকাশিত ‘ইম্যাজিনিং আ হিন্দু নেশন: হিন্দু অ্যান্ড মুসলিম ইন বঙ্কিমচন্দ্র-জ লেটার রাইটিংস’ শীর্ষক লেখায় ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার লেখেন, ‘১৯ শতকে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ এবং পরবর্তী সময়ের মুসলিম বিরোধী হিংসাত্মক রাজনীতির মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছিলেন বঙ্কিম। পাঠকের সামনে সাম্প্রদায়িক হিংসার দুরন্ত পটভূমি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি, বিধ্বংসী ধর্মযুদ্ধের আখ্যা দিয়েছিলেন যাকে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্ররোচনা জোগাতে প্রতিশোধস্পৃহার মিশেলে অনমপনেয় দৃশ্যপট রচনা করেছিলেন’।
‘আনন্দমঠ’ প্রসঙ্গে তনিকার বক্তব্য, ‘মুসলিম কৃষক করুণার পাত্র হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র বা ক্ষমতার অধিকারী নয়। হিন্দু কৃষকও সেই গোত্রে পড়ে না। উপন্যাসে যখনই সাধারণ মানুষ নিজেদের হাতে ক্ষমতা তুলে নিয়েছে, তখনই ঘটেছে অনর্থ। সমাজের অধিপতি, ধর্মগুরু, হিন্দু রাজা এবং সেনাপতিদের হাতেই রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভেদাভেদের রেখা স্পষ্ট’।
বঙ্কিমের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’-এ হিন্দুধর্মের অভূতপূর্ব সূচনা রয়েছে, কিন্তু সুখকর পরিণতি নেই। সেটিরও সমালোচনা করেছেন তনিকা। তাঁর কথায়, ‘(বঙ্কিমের) শেষ উপন্যাসে ‘সীতারাম’-এ, অন্যায় ভাবে গঙ্গারামকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেন অত্যাচারী মুসলিম ফকির এবং একজন কাজি। বিচারের নামে এমন প্রহসন রুখতে না পেরে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা যেখানে, সেই স্থানে পৌঁছ শ্রী, যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেখতে আসা ভিড়ের মধ্যে ছিলেন অনেক হিন্দু। সহ-হিন্দুকে বাঁচাতে ভিড়ের মধ্যে থাকা সেই হিন্দুদের সমবেত করতে সচেষ্ট হন শ্রী। তাঁদের মধ্যে ভ্রার্তৃত্ববোধ, পারস্পরিক দায়িত্ব বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন এই বলে যে, নিজেদের সম্প্রদায়ের এক মানুষ ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে খুন হচ্ছেন। এখানে শ্রী ন্যায় বিচার বা অত্যাচার অথবা অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রজাদের সমবেত করার চেষ্টা করেন না। বরং তাঁর মুখে যে কথা উচ্চারিত হয়, তা স্বধর্মের মানুষের প্রতি সংহতির কথা, হিংসার কথা’।
তবে বঙ্কিমের সমালোচকের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনই তাঁর প্রশংসকের সংখ্যাও অগণিত। কবি মোহিতলাল মজুমদারের কথায়, ‘ভারতের প্রাচীন ধর্মতত্ত্বকে ভিত্তি করিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যে নবধর্ম প্রণয়ন করিয়াছিলেন- তাহার দৃঢ়তম খিলান হল এই দেশপ্রীতি।...ভারতীয় ধর্মের অঙ্গীকৃত করিয়া, এই স্বদেশপ্রীতিকে এতবড় স্থান দিবার কল্পনাও পূর্বে কেহ করে নাই’।
ইতিহাস হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবার লিখেছিলেন, ‘বঙ্কিমবাবু যাহা কিছু করিয়াছেন, ইচ্ছায় করুন বা অনিচ্ছায় করুন, জানিয়া করুন বা না জানিয়া করুন-সব গিয়া এক পথে দাঁড়াইয়াছে। সে পথ জন্মভূমির উপাসনা-জন্মভূমিকে মা বলা-জন্মভূমিকে ভালবাসা-জন্মভূমিকে ভক্তি করা। তিনি যে কার্য্য করিয়াছেন, ইহা ভারতবর্ষে আর কেহ করে নাই। সুতরাং তিনি আমাদের পূজ্য, তিনি আমাদের নমস্য, তিনি আমাদের আচার্য, তিনি আমাদের ঋষি, তিনি আমাদের মন্ত্রকৃৎ, তিনি আমাদের মন্ত্রদ্রষ্টা। সে মন্ত্র বন্দে মাতরম’।
এই 'বন্দে মাতরম' গানটি নিয়ে স্বাধীনতার আগেই আলোড়িত হয়েছিল বঙ্গসমাজ,যার নেপথ্যে ছিল ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জায়গা পাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ গানটি। ‘আনন্দমঠ’ রচনার ঢের আগেই ‘বন্দে মাতরম’ গানটি বেঁধেছিলেন বঙ্কিম। পরে উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ছড়িয়ে পড়েছিল মুখে মুখে। কিন্তু দেশমাতৃকার বন্দনায় রচিত সেই গানও হিন্দুদের থেকে মুসলিমদের আলাদা করে রেখেছিল বলে অভিযোগ ওঠে এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও। বঙ্কিমের লেখা বরাবর সমাদৃত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে, তবে শুধুই সাহিত্যগুণের নিরিখে। ১৮৯৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে নিজকণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে বঙ্কিমের সাহিত্যের সমালোচনার পরিসর থেকে সচেতন ভাবেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন গুরুদেব।
কিন্তু ১৯৩৭ সালে, সেবার কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’-কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু আপত্তি ওঠে ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে/ত্বং হি দুগা দশপ্রহরণধারিণী/কমলা কমলদলবিহারিণী’ –এই পঙক্তি নিয়ে। দশভুজারূপে দেশমাতৃকার পূজা করার যে উল্লেখ রয়েছে গানে, তা সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্রে, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, এই গানে জাতীয় ঐক্যের বাণী প্রতিফলিত হচ্ছে না। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরা। তাতে নেহরু এবং নেতাজিকে নিজের মতামত জানিয়ে চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ।
নেতাজিকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্য়ের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রভাষা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র, সেখানে এ গান সর্বজনীন ভাবে সংগত হতেই পারে না। বাংলা দেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই, তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুকরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আবদার নিয়ে জেদ ধরি, তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে। বস্তুত এতে আমাদের পরাভব’। সভা-সমিতিতে মন্ত্র হিসেবে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ায় আপত্তি ছিল না কবির, সে ক্ষেত্রে প্রথম দু’টি স্তবক গাওয়া হবে বলে ঠিক হয়।
সেই সময় রবীন্দ্রনাথের মতামতে সমর্থন জানান সকলে। জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জন গণ মন’-র প্রথম স্তবকটি স্বীকৃতি পায়। জাতীয় গান হয় ‘বন্দে মাতরম’। কিন্তু সেই নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। বঙ্কিমের রচনায় হস্তক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কাজ করেননি বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করে। ৮০-র দোরগোড়ায় দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথ তখন চারিদিক থেকে আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত। সেই সময় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেই চিঠির বক্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশে জন্মেছি যখন, তখন কটুক্তির হিল্লোল উঠলেই অনুভব করি, স্বদেশী হাওয়া সেবন করছি’। অর্থাৎ বঙ্কিমের সাহিত্যকর্মের অনুরাগী রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বিদ্ধ হতে হয়েছিল।
‘বন্দে মাতরম’-এর সম্পূর্ণ অংশ গাইতে না দেওয়ার কারণেই দেশভাগ হয়ে ছিল, এমন যুক্তি দেন আজকের দিনের রাজনীতিকরাও। ২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচন তখনও হয়নি। তার আগে, ২০১৮ সালে কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জাতীয় স্মারক বক্তৃতায় ‘বন্দে মাতরম’ বিতর্ক খুঁচিয়ে তোলেন অমিত শাহ। বলেন, “বন্দে মাতরম পুরোটা গাওয়া হবে, না তার দু’টি স্তবক, সেই নিয়ে বিবাদ দেখে দুঃখে মন ভরে যায়। তোষণনীতির জন্যই কংগ্রেস বন্দে মাতরম গানকে ভেঙে টুকরো করেছিল। তারই পরিণতি স্বরূপ দেশভাগ হয়।” শাহের সেই দাবি যদিও খারিজ করে দেন নেতাজি প্রপৌত্র সুগত বসু। দেশভাগের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তার জন্যই গানের দুই স্তবক বেছে নেওয়া হয়, শাহ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিষয়টির অপব্যাখ্যা করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাই বঙ্কিমের রচনা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গিয়েছে আজও।