তুহিন অধিকারী, বাঁকুড়া: ন্যুজ শরীরে জঙ্গল পেরিয়ে দূরগ্রামে চিঁড়ে বিক্রি করতে যাওয়া। পথের মধ্যে জিরিয়ে নেওয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পর ফের হেঁটে রওনা বাড়ির পথে। তার মধ্যেই হিমেল বাতাসের মতো একরত্তি মেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতা। তাতেই শ্রান্তি দূর হয়ে যেত প্রবীণার। কিন্তু একরত্তি মেয়ে যে সাক্ষাৎ দেবী, উপলব্ধি হল স্বপ্নাদেশ পেয়ে। বাঁকুড়ার সোনামুখীর হটনগর কালীকে ঘিরে এমনই লোককথা চালু রয়েছে (Diwali 2022)।
কয়েক শতাব্দি ধরে চলে আসছে হটনগর কালীপুজো
গোটা বাঁকুড়া (Bankura News) জেলার মধ্যে কালীক্ষেত্র (Kali Puja) হিসেবেই পরিচিত প্রাচীন পৌরশহর সোনামুখী (Sonamukhi News)। জায়গায় জায়গায় কালীপুজো হয় এখানে। তার মধ্যে অন্যতম হল হটনগর কালীপুজো। প্রতিদিনই দেবীর আরাধনা হয়। তবে কার্তিকেয় অমাবস্যায় তিথি মেনে হয় বাৎসরিক পুজো। সোনামুখীর অন্যতম প্রাচীন পুজো এটি। আর এই কালীপুজোকে ঘিরেই লোককথা চালু রয়েছে। যা মুখে মুখে ফেরে সাধারণ মানুষের।
শোনা যায়, প্রায় ৪৫০ বছর আগে সোনামুখী ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। নগদ টাকা নয়, বিনিময় প্রথাতেই লেনদেন হতো সেই সময়। এই সোনামুখীর বাসিন্দা ছিলেন প্রবীণা তারিণী সূত্রধর। প্রতিদিন হাঁটাপথে জঙ্গল পেরিয়ে বড়জোড়ার নিরশা গ্রামে মাথার ঝুড়িতে চাপিয়ে চিঁড়ে বিক্রি করতে যেতেন। চিঁড়ের বিনিময়ে পাওয়া ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
আর আসার পথেই একটি খালের পাশে বসে জিরিয়ে নিতেন খানিক ক্ষণ। চিড়ে-মুড়ি খেয়ে পেট ভরাতেন। সেখানেই প্রতিদিন তাঁর কাছে হাজির হতো একরত্তি, শ্যামাঙ্গী এক কন্যা। সোনামুখী যাওয়ার জন্য প্রবীণার কাছে বায়না ধরত সে। নানা অজুহাতে তার অনুরোধ এড়াতেন প্রবীণা। কিন্তু একদিন জেদ ধরে বসে ওই একরত্তি কন্যা, যাতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না প্রবীণার।
সেই মতো একরত্তি ওই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন প্রবীণা। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে কোলে নেওয়ার জন্য বায়না করে মেয়েটি। কিন্তু মাথায় আর কাঁখে ধানের ঝুড়ি ও বস্তা থাকায় অসহায়তার কথা জানান প্রবীণা। তাতে মাথার ঝুড়িতে চেপেই যাবে বলে জানায় একরত্তি ওই মেয়ে। উপায় না দেখে বায়না মেনে নেন প্রবীণা।
আরও পড়ুন: Kalipuja 2022: প্রাচীন পুঁথি মেনেই হয় পুজো, সঙ্গত দিতে থাকে নহবত
কিন্তু বাড়ি ফিরে ঝুড়ি নামাতেই মাথায় হাত পড়ে ওই প্রবীণারষ একরত্তি মেয়ের বদলে ঝুড়িতে দুই পাথর পড়ে রয়েছে বলে দেখেন তিনি। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় পাথর দু'টি তুলীতলায় রেখে দেন। সে দিন রাতেই স্বপ্নাদেশ পান। তাতে ওই একরত্তি মেয়ে তাঁকে জানায়, প্রবীণাকে তার পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাঁকড় গাছের নিচে রেখে আসতে পাথর। বইতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্যই পাথর রূপ ধরা বলে জানায়।
সকালে উঠে লালাবাজার এলাকায় মানুষকে বিষয়টি জানান ওই প্রবীণা। কিন্তু সেই সময়, অস্পৃশ্যতা, জাতপাত জেঁকে ধরেছিল সমাজকে। তাই পুরোহিত প্রবীণার কথা মতো পুজো করতে অস্বাকীর করেন। কিন্তু তার পরই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেই অবস্থায় তিনিও স্বপ্নাদেশ পান। তার পর আর সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে। সেই মতো, স্থানীয় জমিদার গিন্নি কাদম্বরীদেবী মন্দির নির্মাণের জন্য পুরোহিতকে এক খণ্ড জমি দেন। সেই থেকেই পুজো হয়ে আসছে।
আজও স্থানীয়রা সেই পুজো করছেন। সুদৃশ্য মন্দির তৈরি করা হয়েছে। প্রাচীন প্রথা মেনে আজও সূত্রধররাই ঘট বয়ে আনার অধিকারী। সারা বছর সেই ঘটই মন্দিরে রেখে পুজো হয়। সুদৃশ্য মন্দির তৈরী হয়েছে। কিন্তু প্রাচীণ সেই প্রথা মেনে আজও সূত্রধররাই কেবল ঘট আনার অধিকারী। এই ঘট সারা বছর মন্দিরে রেখে পুজো করা হয়। বাৎসরিক পুজোর সময় সেই ঘট বিসর্জন দিয়ে নতুন ঘট আনা হয়।
হটনগর কালীর নামকরণ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেন, এক যোগী হটযোগ করে সেখানে সিদ্ধিলাভ করেন। কেউ আবার বলেন, হঠাৎ করেই মা কালী এসেছিলেন, তার জন্যই এমন নাম। স্বপ্নাদেশে যে আঁকড় গাছের নামে প্রবীণাকে পাথর রাখার নির্দেশ দিয়েছিল সেই একরত্তি মেয়ে। সেই গাছ আজও রয়েছে। কিন্তু কোনও কাঁটা নেই তাতে। এমনকি আদি মূলেরও কোনও খোঁজ মেলেনি। আজও পাথর সেই গাছের নিচে রেখেই পুজো হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, ঋতুভেদে রং বদলায় ওই পাথর দু'টি।
সেখানে মূল মন্দিরের সামনে তারিণীর মাথার ঝুড়িতে বসে মা আসছেন, এমন মূর্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে। অন্য দিকে রয়েছে সিদ্ধপুরুষ যোগীর মূর্তি। সব থেকে উপরে রয়েছেন শিব। এ ছাড়াও মূল মন্দিরের ২০-২৫ ফুট উপরে রয়েছে একটি পদ্মফুল, যা অনেক দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমানে প্রাচীন পরম্পরা মেনে সূত্রধর পরিবারের সদস্য বিপত্তারণ সূত্রধরের ছেলে সুকুমার সূত্রধর যেমন মূর্তি তৈরি করেন, তেমনই বিনোদ ভট্টাচার্যের উত্তর পুরুষ গণেশ ভট্টাচার্য এবং গোপাল ভট্টাচার্য এই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন।
সুদৃশ্য মন্দিরের সামনে লোককথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মূর্তিতে
পুজো কমিটির সম্পাদক দেবমাল্য হালদার বলেন, "হটনগর কালীর পুজোয় এলাকা উৎসবের চেহারা নেয়। হটনগর কালীকে এখানে গ্রাম্য দেবী হিসেবেই পুজো করা হয়ে থাকে। এ বছর সাত লাখ টাকার বাজেট রয়েছে। নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, প্রথা মেনে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার আগের দিন এখানে কয়েক হাজার মানুষকে খিচুড়ির প্রসাদ খাওয়ানো হয়।