ভাস্কর মুখোপাধ্যায়, বীরভূম: রোগ-শোক-তাপ কিছুই কি তাঁকে স্পর্শ করে না? নবতিপর চিকিৎসককে বাইরে থেকে দেখলে এমনই মনে হতে পারে। একমাত্র ছেলে চলে গিয়েছেন ২ নভেম্বর। কিন্তু রোগী দেখা বন্ধ করেননি সুকুমার চন্দ্র। এমনকি ছেলের শেষকাজের দিনও চিকিৎসা করেছেন। বয়স ৯৫ বছর, তার উপর সন্তানশোক। কিন্তু মানুষের সেবার কাজ কি কিছুর জন্য থেমে থাকতে পারে? লাভপুরের (Lavpur doctor story) এই নবতিপর চিকিৎসক তাই সকলের কাছে প্রণম্য।
আরোগ্য় নিকেতন...
নবতিপর ডাক্তারবাবু এখন প্রায়ই স্মৃতি হাতড়ান। সে সূত্রেই বললেন, 'কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তোমার চাকরি করা চলবে না। গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা করো।' সেই নির্দেশ মেনেই সেবার ব্রতে গ্রামে এক টাকা ফি নিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। সেই ব্রত থেকে আজও বিচ্যুত হননি। যৎসামান্য ফি-তে রোগী দেখে চলেছেন। যাঁরা পারেন ফি দেন, না দিলেও কোনও ব্যাপার নেই। উল্টে গরিবদের ওষুধপত্র দেন। গত ৬৭ বছর ধরে এই কাজই করে যাচ্ছেন চিকিৎসক। তাঁর ছেলে, সৌমিত্র চন্দ্রও বাবার মতোই ছিলেন। নামকরা শল্য চিকিৎসক, কলকাতার একটি হাসপাতালে যুক্ত থাকলেও বহু বার বিনা খরচে অস্ত্রোপচার করে গিয়েছেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পরিবার সূত্রে খবর, গত ২ নভেম্বর ফুসফুসের সংক্রমণে কলকাতার একটি হাসপাতালে ৬১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। সে দিন সকালেও রোগী দেখেছেন স্থানীয়দের আশা-ভরসার বিশুবাবু ওরফে সুকুমার চন্দ্র।
তাঁর কথায়, 'আমার ছেলে চলে গিয়েছে। তাঁকে তো আটকাতে পারব না। ... এখানে সেবায় পুরোপুরি নিযুক্ত হয়ে আছি। ছেলের শ্রাদ্ধের দিনেও রোগী দেখেছি। তাঁর স্মৃতি ভোলার জন্য রোগী দেখে চলেছি। এই বৃদ্ধ বয়সে পুত্র শোকে ভুগছি।'
গ্রামের কথা...
'আমার গ্রামকে ভালোবাসি। এখানে না এলে এত লোকের সঙ্গে দেখা হতো না', স্পষ্ট বললেন চিকিৎসক। স্মৃতির ডায়েরি হাতড়াতে গিয়ে সঙ্গে জুড়লেন, 'সাউথ ইস্টার্ন রেলে চাকরি করার আগে কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, বিশু প্যাঁটরা নিয়ে কোথায় যাবি? যাস না। গ্রামে চলে যা। গ্রামে তোর নিজের কিছু রোজগার হবে, আর গ্রামের লোকেরও উপকার হবে। আমার সঙ্গে তাঁর পুত্র-পিতার সম্পর্ক ছিল।...পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে এখানেই বসে গেলাম।' কথা বলতে বলতে ছেলের কথায় ফিরে যান। বলেন, 'আমার ছেলের মধ্যে এই আদর্শটাকে প্রতিষ্ঠা করে ছিলাম। ছেলে বড় সার্জেন ছিল। সার্জারি করে কম টাকা নিত। মৃত্যুর আগেও ভিডিও কলে কথা হয়ে ছিল। বলেছিল, খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবে। এখান থেকে কোনও রোগী পাঠালে ছেলে টাকা নিত না। বলতো বাবার রোগী।' সেই ছেলে হঠাৎ চলে যাওয়ায় নবতিপর বাবার হৃদয় কেমন করে ভাঙে, সে হয়তো তাঁকে দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু চিকিৎসক সুকুমার চন্দ্রের সেবা-ব্রতে কোনও ধাক্কা লাগেনি।
আরও পড়ুন:'আমি মন্ত্রী, আমি এই সেলে থাকব?' অসুস্থ দাবি করে SSKM-এ ভর্তির বায়না জ্যোতিপ্রিয়র