গোপাল চট্টোপাধ্যায়, বীরভূম: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও সাবেকি পুজোর গন্ধ আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি। বীরভূমের সুরুলের জমিদার বাড়ির দুর্গা মন্দিরের পুজো এবছর ২৮৭ বছরে পড়ল । দেশ-বিদেশের ছড়িয়ে থাকা সরকার বাড়ির সদস্যরা প্রতি বছর এই পুজোয় মিলিত হন । পারিবারিক এই মিলন মেলায় পঞ্চমীর সকাল থেকে বিসর্জন পর্যন্ত থাকে বিভিন্ন রীতি মেনে অনুষ্ঠান । এই চলছে জমিদার বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি ।


পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, থামযুক্ত নাটমন্দির, নানারঙের কাঁচের ফানুস আর বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি মনে করিয়ে দেয় সাবেকি ঐতিহ্য আর রাজকীয় জৌলসের কথা। সময়ের প্রভাবে গ্রাম বাঙলার বহু পুজোকে আধুনিকতা গ্রাস করলেও বীরভূম জেলার সুরুলের জমিদার বাড়ির পুজোয় আজও মিশে আছে মাটির গন্ধ, শিকড়ের টান আর আভিজাত্য। তবে শুধু পুজো পার্ব্বন নয়, এই পরিবারের সঙ্গে  অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও। দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা বছরের ৩৬৫ দিন ভিড় করেন । বিশেষ করে সপ্তমীর দিন থেকে বিসর্জন এই সুরুল জমিদার বাড়ির পূজাকে ঘিরে তৈরি হয় বিভিন্ন রীতি মেনে অনুষ্ঠান । জমিদার বাড়ির বাইরে বসে মেলা। বিকিকিনি হয় বেশ ভালোই । কিন্তু গত বছরে করোনা অতিমারীর ফলে সরকারি বিধি নিষেধ থাকার জন্য মন্দির চত্বর মানুষজনের ভিড় অনেক কম ছিল । বন্ধ ছিল মেলা ।


ইতিহাস ও জমিদার বাড়ি সদস্য শিবুপ্রসাদ সরকার থেকে জানা গেছে, অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বর্ধমান জেলার ছোট নীলপুর অঞ্চল থেকে ৩০০ বছর আগে নিঃসন্তান দম্পতি সুরুল এসেছিলেন । তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি সরকারের হাত ধরেই এই পরিবারের সমৃদ্ধির সূচনা। অতীতে সুরুল গ্রামটি ছিল এই সম্ভ্রান্ত পরিবারের বানিজ্যকেন্দ্র মাত্র।  তখন বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় বেলজিয়াম থেকে ঝাড়বাতি দিয়ে মন্দির চত্বর সাজানো হয় । 


জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোতে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, শোভাযাত্রা হয় দর্শনীয়। দিঘিতে স্নান করিয়ে সাবেকি পালকি করে নবপত্রিকা মন্ডপে নিয়ে আসা হয়। সানাই, কাঁসর, ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা হয়।  প্রথা অনুযায়ী, তিনদিন বলি হয়। অষ্টমীর দিন ছাগ বলি , নবমী দিন আখ ,   সপ্তমীতে চাল কুমড়ো বলি হয় । এখানে কোন অন্য ভোগ হয় না । কাছারি বাড়িতে রন্ধন শালায় ভিয়েন বসে, মিষ্টান্ন ভোগ হয়। দশজন কারিগর থাকেন। মিষ্টান্ন ও অন্যান্য ভোগ তৈরি হয় । ভোগে থাকে গাওয়া ঘিয়ের লুচি , সুজি , ছানা । এই সমস্ত ভোগ মা দুর্গা কাছে নিবেদন করা হয় । সরকার জমিদারবাড়ির ২০০ টি পরিবার রয়েছে। ১  হাজারের বেশি সদস্য সকলেই দেশ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে । পুজোর  কটা দিন তাঁরা সবাই আসার চেষ্টা করেন। দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে পরিবারের সদস্যেরা নারায়ণ মন্দিরে মিলিত হন। আজও সেখানে শাঁখ বাজিয়ে শঙ্খ চিলের আহ্বান করা হয়। সরকার পরিবারের সদস্যেরা শঙ্খ চিলের দর্শনকে একটি শুভ সঙ্কেত মনে করেন। আগে বাহকরা কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে গেলেও এখন নিরাপত্তার জন্য প্রতিমা বিসর্জন হয় ট্রলিতে। তবে অতীতের স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও জ্বালানো হয় মশাল। পাশাপাশি বীরভূম জেলার পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে বিসর্জনের দিন বিশেষ নজরদারি রাখা হয় ।