বোলপুর: কলকাতার ১৪৫ কিমি উত্তরে অবস্থিত, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে অন্যতম (Bolpur Lok Sabha Constituency)। রবি ঠাকুরের স্মৃতির শহর (Rabindranath Tagore)। ১৯৬২ সালে এই লোকসভা কেন্দ্র গঠিত হয়। এর অধীনে রয়েছে মোট ৭ টি বিধানসভা। একসময় কংগ্রেসের (Congress) ঘাঁটি ছিল বোলপুর লোকসভা। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ও (Siddhartha Shankar Roy) লড়েছেন এই লাল মাটির দেশে। কংগ্রেসের পর বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র চলে যায় বামেদের দখলে। লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (Somnath Chatterjee) ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি বোলপুরের সাংসদ ছিলেন। তারপর বাম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের হাত হয়ে সবশেষে এই কেন্দ্র এখন তৃণমূলের দখলে (TMC)। 

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর বছর

সাল ১৯৮৪। ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে দেখা যায়, বছরটা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর বছর (Indira Gandhi)। গোটা দেশে কংগ্রেসের প্রবল হাওয়া। তা সত্ত্বেও, কবিগুরুর স্মৃতি বিজরিত এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের পর , বোলপুরে সুরবদল করেছিলেন শরদীশ রায়। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি কংগ্রেসের এ কে চন্দের পর এই কেন্দ্রে টানা চারবার জিতেছিলেন শরদীশ রায়। সেসবছর মমতার কাছে যাদবপুরে হেরেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এরই মাঝে  শরদীশ রায়ের মৃত্যু হয়। শরদীশের প্রয়াণে ১৯৮৪ সালে লোকসভা উপনির্বাচনে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জয়ী হন। তারপর আর ফিরে তাঁকাতে হয়নি।

৫ বার এই কেন্দ্র থেকে জয় আনেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা সিপিএম-র তৎকালীন হেভিওয়েট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই এই কেন্দ্র দীর্ঘ সময় ধরে বামেদের ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত ছিল।  ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি তিনিই টানা ৫ বার এই কেন্দ্র থেকে জয় আনেন। এরপর ২০০৯ সালে সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম বামেদের হয়ে জয়ী হন। দীর্ঘ বাম রাজত্বের পর, অবশেষে ২০১৪ সালে রং বদলায় এই লোকসভা কেন্দ্রের। শিকড় ছড়িয়ে প্রথম ফোঁটে ঘাসফুল(TMC)।

অনুপমের হাত ধরেই রঙ বদল

বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে বামেদের পর, তৃণমূলের হয়ে প্রথম জয় আনেন অনুপম হাজরা (Anupam Hazra)। কিন্তু ঐতিহাসিক জয়ের পরও তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে জায়গা হারান। ২০১৯ সালে দল বিরোধী কাজের জন্য, তৎকালীন বোলপুরের সাংসদ অনুপম হাজরাকে বহিষ্কার করে তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ বহুদিন থেকেই তাঁর একাধিক মন্তব্য এবং কাজ বিতর্ক তুলেছিল দলের অন্দরে। কিন্তু তাঁর করা বিতর্কিত ফেসবুক পোস্ট শেষ অবধি কাল হয়ে দাঁড়ায়।

বহিষ্কৃত অনুপম

তৎকালীন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় (বর্তমানে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলে রয়েছেন) অনুপম হাজরা দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করেন। তারপর ২০২০ সাল থেকে বিজেপির জাতীয় সম্পাদক পদে রয়েছেন অনুপম হাজরা।  অনুপমের সঙ্গে সঙ্গে সেসময় আরও একজন তৃণমূলের থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি সৌমিত্র খাঁ (Soumitra Khan)। বহিষ্কারের পরে এই দুইজনেই বিজেপিতে যোগ দান করেন। দুজনেই বর্তমানে বিজেপির বড় পদে রয়েছেন। সৌমিত্র খাঁ এবার বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী পদে লড়ছেন।

বোলপুর জয়ে ভূমিকা ছিল আরও একজনেরও

তবে বামদের থেকে এই কেন্দ্র ছিনিয়ে নেওয়ার পিছনে, তৃণমূলের হয়ে আরও একজনের ভূমিকা রয়েছে। তিনি হলেন অনুব্রত মণ্ডল ( বর্তমানে গরু পাচার মামলায় জেলে রয়েছেন)। অনুব্রতর সঙ্গে অনুপম হাজরার সম্পর্ক কারও অজানা নয়। অনুব্রতকে 'কাকা' বলেই ডাকতেন 'ভাইপো' অনুপম হাজরা। বোলপুরে অনুব্রত মণ্ডলের প্রতিবেশীও ছিলেন এই অনুপম হাজরা। যদিও এই সম্পর্ক তাঁর বহিষ্কার আটকায়নি। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে যাদবপুর কেন্দ্রে বিজেপির হয়ে প্রার্থী পদে দাঁড়িয়েছিলেন অনুপম হাজরা। কিন্তু চোদ্দর ছায়া আর ফিরে আসেনি। বিশাল বড় ভোটের ব্যবধানে মিমি চক্রবর্তীর কাছে হার মানেন অনুপম হাজরা।

অনুপম গেলেও সবুজেই অটুট বোলপুর, দায়িত্ব নিভিয়েছেন অসিত

 এদিকে অনুপমকে বহিষ্কৃত করার পর, উনিশে রঙ বদলায়নি বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রেরও। বরং 'সবুজ'-এই ছায়া সুনিবিড় ছিল বোলপুর। শিকড় ছড়িয়ে বড় ভোটের ব্যবধানে সবাইকে পিছনে রেখে উনিশের লোকসভা ভোটে (Lok Sabha Election 2024) সেবার জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী অসিত কুমার মাল। সেই অসিতই এবার বোলপুরে, তৃণমূলের হাতিয়ার। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের হয়ে তৃণমূল প্রার্থী পদে লড়বেন অসিত কুমার মাল। এবারেও কি উনিশের ধারাই বজায় রাখবেন ? তা সময়ই বলবে।

২০২৪ বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে কারা পেলেন টিকিট ? 

রাজনৈতিক দল প্রার্থীর নাম
তৃণমূল কংগ্রেস অসিত কুমার মাল
বিজেপি পিয়া সাহা
বাম শ্যামলী প্রধান

কে এই বিজেপির প্রার্থী পিয়া ?

বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের এবারের বিজেপির প্রার্থী পিয়া সাহা।তৃণমূলের বুথ সভাপতি তন্ময় সাহার বোনই হলেন বোলপুরের বিজেপির প্রার্থী পিয়া সাহা। ২০১৫ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে কাউন্সিলর রূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তারপর দুবার সাঁইথিয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে দাঁড়ায়েছিলেন তিনি। যদিও কোনওবারই জয়লাভ করতে পারেননি। 

ইতিহাস কি ফিরে আসে? এবার বোলপুরে সিপিএমের বর্ষীয়ান নেত্রী শ্যামলী প্রধান

সিপিএমের হয়ে দাঁড়িয়েছেন শ্যামলী প্রধান। কলেজ জীবনে বাম ছাত্র রাজনীতি নিয়ে পথ চলা শুরু। ১৯৯১ সালে সিপিএমের সদস্য হন তিনি। বর্তমানে রাজ্য কমিটির সদস্য এবং মহিলা সংগঠনের জেলা সভানেত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনকালে একাধিক নির্বাচন পার করেছেন তিনি। জয়-পরাজয় এসেছে। ইতিহাস কি ফিরে আসে? তবে এবার নব্বই শতকের ছায়াই ফের ফিরিয়ে আনবেন কিনা, তা জানা যাবে জুনেই।

 এবিপি সি ভোটারের সমীক্ষা অনুযায়ী বোলপুরে সম্ভাব্য জয়ী হবে কে ?

১৩ মে বোলপুরে লোকসভা নির্বাচন। সম্ভাব্য জয়ী হবে কে ? কে পিছিয়ে ? এনিয়ে জল্পনা বেড়েই চলেছে। ঠিক এমন সময়েই সামনে এসেছে এবিপি সি ভোটারের সমীক্ষা। মূলত এরাজ্যের ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে, সমীক্ষা চালিয়েছিল এবিপি সি ভোটার। এই সমীক্ষা চলেছে গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। সবমিলিয়ে মোট ১ লক্ষ ১১ হাজার ২৫৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন সমীক্ষকরা। এবিপি সি ভোটারের সমীক্ষা বলছে, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে এখনও পর্যন্ত সম্ভাব্য জয়ী তৃণমূল প্রার্থী অসিত মাল। 

২০১৯ সালের বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের ফল

রাজনৈতিক দল প্রার্থীর নাম প্রাপ্ত ভোট ভোটের শতাংশ নেটফল
তৃণমূল কংগ্রেস অসিত কমার মাল  ৬৯৯,১৭২ ৪৭.৮৫ বিজয়ী
বিজেপি রামপ্রসাদ দাস ৫৯২,৭৬৯ ৪০.৫৭ পরাজিত
সিপিএম রাম চন্দ্র ডোম  ৯১,৯৬৪ ৬.২৯ পরাজিত
কংগ্রেস অভিজিৎ সাহা ৩০,১১২ ২.০৬ পরাজিত
আরভিএনপি সীমন্ত মণ্ডল  ১৭,০১৩ ১.১৬ পরাজিত
বিএসপি সমীরণ দাস  ৯,১৬৫ ০.৬৩ পরাজিত
এসইউসিআইসি বিজয় দলুই ৮,৭৯৭ ০.৬০ পরাজিত
নোটা   ১২,২৭৮ ০.৮৪ পরাজিত

আরও পড়ুন, আগের ভোটে কেমন ছিল সমীকরণ ? পাল্লা ভারী কার ? কী বলছে সম্ভাব্য ভোট শেয়ার ? নজরে জলপাইগুড়ি

তথ্যসূত্র : Election Commission of India, Govt Website

আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।