শুভেন্দু ভট্টাচার্য, কোচবিহার : সভ্যতার অগ্রগতি তো হচ্ছে, কিন্তু তার মূল্য এমন কিছু দিয়ে চোকাতে হচ্ছে যার অভাব পূরণ করা দুষ্কর। কথা হচ্ছে, প্রকৃতির। একসময় গাছপালা-জঙ্গলে ঘেরা ছিল পরিবেশ। কিন্তু, সময়ের চাহিদা মেনে গড়ে উঠছে ফ্ল্যাটবাড়ি, বিশাল বিশাল অট্টালিকা। যার জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দেখা গেছে। আবহাওয়া গতিপ্রকৃতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তার হাত ধরে প্রাণহানি। সঙ্গে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই। এই পরিস্থিতিতেও সমাজে এমন কাউকে কাউকে দেখা যায় যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে পরিবেশ রক্ষার কাজে ব্রতী হন। ঠিক তেমনই এক উদাহরণ রয়েছে কোচবিহারে। এখানকার রাজপ্রাসাদের কর্মী বিনয় দাস।


'নেশা' তাঁর গাছ লাগানো । গত ১৩  বছরের বেশি সময় ধরে কোচবিহার শহর ও তার আশপাশের এলাকায় ১০ হাজারেরও বেশি গাছ বসিয়েছেন তিনি। শুধু গাছ লাগানোই নয়, সঙ্গে গাছের পরিচর্যাও করেন তিনি। তাই কোচবিহারে তিনি 'সবুজ বিনয়' নামে পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ তাঁর চিন্তায়, তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে। অবাধে গাছ কেটে ফেলা কষ্ট দিত তাঁকে। তাই ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগানো শুরু করেন। কোচবিহার শহরের বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় বহু গাছ লাগিয়েছেন তিনি। শুধু গাছ লাগানোই নয়, নিজের লাগানো গাছের পরিচর্যাও যেমন করেন, তেমনই অন্যদের লাগানো গাছ যেগুলোর পরিচর্যা হয় না, সেগুলোও দায়িত্ব নিয়ে দেখভাল করেন বিনয় বাবু। 


'সবুজ বিনয়'-এর রোজনামচা-


প্রতিদিন নিজের বাইক নিয়ে সকাল ৫টা নাগাদ বেরিয়ে পড়েন তিনি। ৮টা পর্যন্ত এই কাজ করেন। গাছ লাগানোর জন্য একাধিক যন্ত্র কিনেছেন নিজের টাকায়। তাঁর কাজের জন্য ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন বিনয় বাবু। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে তাকে শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি যেমন গাছ লাগান, তেমনই বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবকও তৈরি করেছেন, যাঁরা তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেন। 


বিনয় বাবু বলেন,  'একসময় প্রত্যেক বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, পেছনে ফলের বাগান থাকত। বঙ্গ সংস্কৃতির গাছ- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুতে ভরা ছিল। এখন প্রত্যেক বাড়ি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। আজ থেকে ১৩০ বছর আগে কোচবিহারের মহারাজা ছোট ছোট খণ্ডগণ বানিয়েছিলেন শহরের আশপাশে। আজ আমরা সভ্যতার অহঙ্কারে সব কেটে ফেলে দিয়েছি। তাই আমরা আবার ছোট ছোট খণ্ডবন বানানোর চেষ্টা করছি।' কোচবিহার শহর সংলগ্ন তোর্ষা নদীর চরে ১০০ বিঘা জমি নেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি বনসৃজন করবেন। ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বিনয় বাবু বলেন, 'একসময় এই জায়গায় খয়ের বাগান ছিল। আবার সেই বাগান ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।' 


একদিকে যখন উন্নয়নের দাপটে শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ বনাঞ্চল, সেখানে উল্টো স্রোতে  হেঁটে, আবার সবুজ কোচবিহারকে ফিরিয়ে আনার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন বিনয় দাস।