জয়নগর: প্রায় কলকাতার গা ঘেঁষে অবস্থান। অথচ ভৌগলিক তাৎপর্য হোক বা পর্যটন, ইতিহাস হোক বা অর্থনীতি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা সব দিক থেকেই স্বতন্ত্র। স্বকীয়।


এক প্রান্তে তিলোত্তমা। অন্য প্রান্তে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য়। উত্তর দিকে কলকাতা। পূর্ব দিকে বাংলাদেশ। পশ্চিম দিকে হুগলি নদী। দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। গঙ্গাসাগর। কপিল মুনির আশ্রম। জেলা হিসাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভূ পরিচয় বেশ আকর্ষণীয়। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম জেলা। জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম। 


ইতিহাস, অবস্থান, ভূ-পরিচয় থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, পর্যটন - দক্ষিণ ২৪ পরগনার অনেক তথ্যই হয়তো সাধারণের কাছে অজানা। আর অজানাকে জানার জন্যই এই নিবন্ধ। ইতিহাসের অলিন্দ ছুঁয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বর্তমানের সঙ্গে পরিচয় করাতেই এই মানস সফর।


ইতিহাস


বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের এই অংশের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে কপিল মুনির আশ্রমের কথা রয়েছে পুরানেও। ডায়মণ্ড হারবারের দেউলপোতা, কুলপির হরিনারায়ণপুরে খনন করে প্রস্তুরযুগের অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। সমৃদ্ধশালী এই এলাকার প্রধান বন্দর ছিল চন্দ্রকেতুগড়। এমনকী, প্রাচীন রোমের সঙ্গে জলপথে বাণিজ্যিক যোগসূত্রও পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের গবেষণায়। যা প্রমাণ করে, এই জনপদ সুপ্রাচীন।


বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের লেখা থেকে জানা যায় যে, ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আদি ভাগিরথীর পাড়ে কালীঘাট, বোড়াল, রাজপুর, মহিনগর, বারুইপুর, জয়নগর, মজিলপুর, ছত্রভোগের মত জনপদ গড়ে উঠেছিল। শ্রী চৈতন্যদেব ভাগিরথীর পাড় ধরে পুরী যাওয়ার পথে বারুইপুরের কাছে আটসিরাতে এবং মথুরাপুরের ছত্রভোগে থেমেছিলেন।


ইতিহাস বলছে, ১৫৩৮ সালে পর্তুগিজরা গৌরের শেষ ইলিয়াস শাহি সুলতান গিয়াসুদ্দিন মামুদের থেকে সরস্বতী এবং ভাগীরথী-হুগলির সংযোগস্থলে অবস্থিত সাতগাঁওতে বসতি গড়ার অনুমতি পায়। ১৫৯০ সালে বিদ্যাধরী নদীর তীরে তার্দা বন্দরে পর্তুগিজরা প্রথম ঘাঁটি গাড়ে। সেই সময়ে বাংলায় মুঘলদের বিরুদ্ধে বারো ভুইয়াঁদের মিত্রশক্তি হয়ে ওঠে পর্তুগিজরা। পর্তুগিজ জলদস্যুরা নদীপথে লুঠপাট চালাত বলেও অভিযোগ ওঠে। পরে বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম, যশোররাজ প্রতাপাদিত্য গোটা ২৪ পরগনা জেলার অধিপতি ছিলেন। তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে জড়ান। 


এরপর ১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে শেষ জরিপে এই এলাকাকে হুগলি চাকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পলাশির যুদ্ধের ছ'মাস পরে, ১৭৫৭ সালে ২০শে ডিসেম্বর মীরজাফর কলকাতা-সহ দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত ২৪টি পরগনাকে কলকাতার জমিদারি বা ২৪ পরগনার জমিদারির নামে ইংরেজদেন দান করেছিলেন। সেই থেকেই এই এলাকার নাম ২৪ পরগনা।


১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি ও চাষ শুরু হয়। ১৭৭৪ সালে লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর পর এই অঞ্চলটি আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে আসে। ১৭৯৩ সালে পরগনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৭১ সালে কলকাতা ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ২৪ পরগনা জেলা তখনও অবিভক্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৮৩ সালে অশোক মিত্রের প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। সেই মতো ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ পূর্বতন ২৪ পরগনা উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিভক্ত হয়। 


অবস্থান


দক্ষিণ ২৪ পরগনার সদর আলিপুরে অবস্থিত। উত্তর দিকে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা। পূর্ব দিকে বাংলাদেশ। পশ্চিম দিকে হুগলি নদী ও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ ২৪ পরগনা আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম ও জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। বর্তমানে জেলার পাঁচটি মহকুমা - আলিপুর, বারুইপুর, ক্যানিং, কাকদ্বীপ ও ডায়মন্ড হারবার। রয়েছে ২৯টি ব্লক ও ৭টি পৌরসভা।


ভূ পরিচয়


জেলার মোট আয়তন ৯,৯৬০ বর্গ কিলোমিটার। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমির দক্ষিণাঞ্চলের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অংশ। জেলার প্রায় পুরোটাই পলিগঠিত সমতলভূমি। একদিকে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ঘেরা সুন্দরবন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নদীগুলির মধ্যে হুগলি, বিদ্যাধরী, পিয়ালী, মাতলা, ইছামতী ও যমুনা প্রধান।


অর্থনীতি


জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্যচাষ নির্ভর। মৎস্যচাষ সমগ্র দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাঁচ লক্ষেরও বেশি লোক এই জেলায় মৎস্যচাষের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল এই জেলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। কৃষি, মৎস্যচাষ, বস্ত্র শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর নির্ভর করে রয়েছে এই জেলার অর্থনীতি।


রাজনীতি


একটা সময় বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই জেলা। কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেসেছে এই জেলাও। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় মোট ৪টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। জয়নগর, মথুরাপুর, ডায়মন্ড হারবার ও যাদবপুর। চারটি কেন্দ্রই রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। জেলায় মোট ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, সাগর, কুলপি, রায়দিঘি, মন্দিরবাজার, জয়নগর, বারুইপুর পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, ক্যানিং পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, মগরাহাট পূর্ব, মগরাহাট পশ্চিম, ডায়মন্ড হারবার, ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর, সোনারপুর দক্ষিণ, ভাঙড়, কসবা, যাদবপুর, সোনারপুর উত্তর, টালিগঞ্জ, বেহালা পূর্ব, বেহালা পশ্চিম, মহেশতলা, বজবজ ও মেটিয়াব্রুজ। এরমধ্যে একমাত্র ভাঙড় রয়েছে আইএসএফের হাতে। বাকি ৩০টি কেন্দ্র তৃণমূলের দখলে।


যোগাযোগ ব্যবস্থা


রাজধানী শহর কলকাতার কার্যত গা ঘেঁষে অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। এমনকী, জেলার কিছু অংশ বৃহত্তর কলকাতার অংশ। এই জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা মূলত ট্রেনের মাধ্যমে বেশি চলে। মূলত শিয়ালদা থেকে প্রচুর লোকাল ট্রেন সারাদিন ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে থামে। হাওড়া ও ধর্মতলা থেকে বেশ কিছু দূরপাল্লার বাসও চলাচল করে। সারাদিন ধরে কলকাতা থেকে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি বাস চলাচল করে। সুন্দরবন ও গঙ্গাসাগর যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম জলপথ। ফেরি ও নৌকা বা লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে। আশেপাশের জেলাগুলির সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাস। এছাড়া বেসরকারি বাসও রয়েছে অনেক।


পর্যটন 


৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭। ইউনেস্কোর ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি পায় সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান এই জেলায় অবস্থিত। এটি একটি জাতীয় উদ্যান, ব্যাঘ্র প্রকল্প ও বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বৃহত্তম অভয়ারণ্য সুন্দরবন। এখানকার সজনেখালি, লুথিয়ান দ্বীপ ও হ্যালিডে দ্বীপে আরও তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এছাড়া পাথরপ্রতিমার কাছে রয়েছে ভরতপুর কুমির প্রকল্প। সজনেখালিতে রয়েছে পাখিরালয়। 


পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার মতো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলাতেও অসংখ্য মেলা আয়োজিত হয়। জেলার প্রধান মেলা হল গঙ্গাসাগর মেলা, জয়নগরের দোল উৎসবের মেলা, মজিলপুরের ধন্বন্তরীর বেশের মেলা, বড়িশার চণ্ডীমেলা ও আছিপুরের চিনা মন্দিরের মেলা। ফি বছর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সাগরদ্বীপে লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। কপিল মুনির মন্দিরে চলে পুজোপাঠ ও মেলা। কপিল মুনির নতুন মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৮৯৯ সালে।


আরও পড়ুন- মাটিতে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ! ২ দিন পরে 'স্বাধীনতা'! চেনা মালদার অচেনা দিক