মালদা: একদিকে ভিনরাজ্য, একদিকে ভিনদেশ। মাঝে এই জেলা। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মাঝে সেতুর মতো রয়েছে মালদা। শশাঙ্ক থেকে সুলতানি আমল, তারপর ইংরেজ শাসন পেরিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারত। বারবার সীমানা, ভৌগোলিক আকার-আয়তন বদল হয়েছে এই এলাকার। কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে বরাবরই প্রথম সারিতেই রয়েছে অধুনা মালদা জেলা (Malda District)।
ইতিহাস:
এই গোটা এলাকার ইতিহাস (Malda History) বহু পুরনো। এমন সময় থেকে এই এলাকার বিষয়ে নানা তথ্য় জানা যায় যখন মালদা নামের কোনও জেলাই ছিল না। ইতিহাসে এই এলাকা গৌড়বঙ্গ নামে পরিচিত। পানিনির লেখায় গৌড়পুর-এর কথা জানা যায়। মনে করা হয় তা আদতে অধুনা মালদা জেলা বা তার লাগোয়া এলাকাই ছিল। গৌড় (Gour) ও পান্ডুয়া এই দুটিই অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ। গৌড়ের সীমানা সময়ে সময়ে বদলে গিয়েছে। বাংলাদেশের বগুড়া থেকে পাওয়া একটি শিলালেখে ব্রাহ্মীলিপিতে গৌড় ও পান্ডুয়া (তৎকালীন পুণ্ড্রবর্ধন) -এর উল্লেখ রয়েছে যা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ শিলালেখ থেকে জানা যায় এই এলাকা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তবে গৌড়ের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম শশাঙ্ক। কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে একইসঙ্গে উচ্চারিত হয় গৌড়ের নাম। তারপরে পাল রাজবংশের শাসনের সময়েও অত্যন্ত সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে গৌড় ও লাগোয় এলাকা। তারপরে সেন বংশের আমলে, রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বে গৌড়ের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের পতন হয় সেন বংশের। তারপর বাংলায় ছিল টানা মুসলিম শাসকদের শাসন। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতেও নাকি এই এলাকার নাম পাওয়া যায়। এই দীর্ঘ ইতিহাসের ছাপ এখনও রয়ে গিয়েছে। অধুনা মালদা জেলায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সৌধ ও স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপে দেখা যায় বিভিন্ন সেই সময়ের গঠনশৈলি ও সংস্কৃতির ছাপ।
এর পর ব্রিটিশ আমল। ১৮১৩ সালে পূর্ণিয়া (Purnia), দিনাজপুর ও রাজশাহি জেলার কিছু অংশ নিয়ে প্রথম তৈরি হয় মালদা জেলা। ১৮৩২ সালে জেলার জন্য আলাদা ট্রেজারি তৈরি হয়। ১৮৫৯ সালে পূর্ণসময়ের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় মালদা জেলার জন্য। ব্রিটিশ আমলের নথি বলছে তারপর থেকে এই জেলাকে প্রথমে রাজশাহি ডিভিশনে এবং পরে ভাগলপুর ডিভিশনের অন্তর্গত করা ছিল। কিন্তু ১৯০৫ সালে, এটা আবার রাজশাহি ডিভিশনের অন্তর্গত করা হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ওই ডিভিশনেই ছিল।
স্বাধীনতা ও দেশভাগ:
স্বাধীনতার সময়ে দেশভাগের জন্য প্রভাবিত হয়েছিল এই জেলাও। কোনদিকে যাবে মালদা তা নিয়ে সংশয় ছিল একেবারে প্রথম দিকে। স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিনদুয়েক এই জেলা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ছিল। ব়্যাডক্লিফ লাইনের সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট মালদা জেলা ভারতের (India) অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে সেইসময়ের মালদায় থাকা ১৫টি থানার মধ্যে ৫টি থানা যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ)।
অবস্থান:
পশ্চিমবঙ্গকে (West Bengal) লম্বালম্বি দেখলে ঠিক মধ্যিখানে অবস্থিত এই জেলা। উত্তরে রয়েছে উত্তর দিনাজপুর। দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ। পূর্বে বাংলাদেশ। পশ্চিমে ঝাড়খন্ড ও বিহার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মালদা। বাংলাদেশের সঙ্গে দেড়শো কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্ত রয়েছে মালদার। দক্ষিণবঙ্গ থেকে শিলিগুড়ি যেতে গেলে মালদার মধ্য দিয়েই যেতে হয়। বাংলায় গঙ্গা প্রবেশ করেছে মালদহ জেলা দিয়েই। মালদার মানিকচক দিয়ে প্রথম বাংলায় ঢুকেছে গঙ্গা। এমন ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বাণিজ্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা।
ভূ-পরিচয়:
মালদা জেলা মূলত গঙ্গা অববাহিকা (Ganga Basin) অঞ্চল। ভৌগোলিকভাবে বিচার করলে মালদা জেলার ভূপ্রকৃতি তিনভাগে ভাগ করা যায়। তাল, দিয়ারা এবং বারিন্দ। এই জেলা বন্যা কবলিত এলাকার মধ্যে পড়ে। মালদা জেলায় নদী ভাঙনের সমস্যাও ভয়াবহ। সারা বছরই, বিশেষ করে বর্ষাকালে ভাঙন সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এখানে। তার জন্য একাধিক এলাকায় বাসস্থান সংক্রান্ত সঙ্কট দেখা যায়। গঙ্গা এই জেলার অন্যতম নদী। তাছাড়া, মালদার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী হল মহানন্দা (Mahananda), ফুলহার এবং কালিন্দি। সমুদ্রতল থেকে মোটামুটি ১৭ মিটার মতো উঁচু এই জেলার অধিকাংশ জায়গা। মালদা জেলার আবহাওয়া আর্দ্র-ক্রান্তীয়। গরমে এখানে ভয়াবহ গরম পড়ে। অনেকসময়েই লু বওয়ার মতো পরিস্থিতিও হয়। আবার শীতকালে এখানে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। শৈত্যপ্রবাহের পরিস্থিতি দেখা হয়।
অর্থনীতি:
মালদা মূলত কৃষিপ্রধান (Malda Agriculture) জেলা। মূলত ধান এবং আম উৎপাদিত হয় এখানে। মালদা জেলার কথা উঠলেই প্রথমে মনে পড়ে ফজলি আমের কথা। ফজলি মূলত মালদারই আম। বড় আকারই এর পরিচয়। মালদায় উৎপাদিত আম রফতানি হয় বিদেশেও। এই জেলায় একাধিক আম বাগান রয়েছে। যেখানে আরও নানা প্রজাতির আম চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া, ধান, ডাল, তৈলবীজও চাষ হয় এখানে। মালদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিচু চাষ হয়ে থাকে। ইংরেজবাজার এলাকা মূল বাণিজ্যিক স্থল। কাছেই বিহার, ঝাড়খণ্ড থাকায় বাণিজ্যিক লেনদেনও হয়ে থাকে। মালদায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রয়েছে মহদিপুর স্থলবন্দর (Malda Mahadipur Landport)। যা ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের (Cross Border Business) জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতি:
মালদহ জেলা রাজ্য-রাজনীতির দিক থেকে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। এই জেলায় বেশ বড় সংখ্যায় সংখ্যালঘু নাগরিকের বাস রয়েছে। কংগ্রেসের একসময়ের শক্ত ঘাঁটি মালদহ। মালদার প্রবাদপ্রতিম কংগ্রেস নেতা ছিলেন আবু বরকত আতাউর গণি খান চৌধুরী। দীর্ঘদিনের এই সাংসদের (অধুনা প্রয়াত) সঙ্গে মালদা জেলার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একসময়ে কংগ্রেসের (Congress) শক্ত ঘাঁটি হলেও এখন তাদের শক্তি কমেছে। বামেদেরও ভাল সংগঠন ছিল মালদা জেলায়। ২০১১ সালের পালাবদলের পরেও এখানে বাম-কংগ্রেসের শক্ত ভিত ছিল। এমনকি ২০১৬ সালেও মালদায় সেভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল (TMC)। তবে পরে এই জেলাই তৃণমূলের খাসতালুকে পরিণত হয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি (BJP) এখানে ভাল ফল করে। তারপর থেকে সীমান্তবর্তী এই জেলায় সংগঠন বাড়িয়েছে পদ্মশিবিরও।
প্রশাসনিক ভাবে মালদা দুটি সাব ডিভিশনে (Sub Division) বিভক্ত। ১. মালদা সদর এবং ২. চাঁচল। মহিলা থানা ও সাইবার থানা নিয়ে মালদা জেলায় মোট ১৬টি থানা রয়েছে।
মালদহ জেলায় ১২টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলি হল, হবিবপুর, গাজোল, চাঁচল, হরিশ্চন্দ্রপুর, মালতীপুর, রতুয়া, মানিকচক, মালদা, ইংরেজবাজার, মোথাবাড়ি, সুজাপুর, বৈষ্ণবনগর। এই জেলায় ২টি লোকসভা কেন্দ্র মালদা উত্তর ও মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র।
উল্লেখযোগ্য:
মালদার জেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি, জড়িয়ে রয়েছে নানা খাবার। রসকদম্ব এই জেলার অন্যতম বিখ্যাত মিষ্টি। পোস্তর দানা ব্যবহার করা হয় এই মিষ্টি তৈরিতে। মালদার কথা উঠলেই নাম ওঠে গম্ভীরার (Gambhira Folk Art)। গম্ভীরা স্থানীয় লোকসংস্কৃতি। সাধারণ বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা, সুখ-দুঃখের কথা এই লোকগান-নাচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। বহু প্রাচীন কাল থেকে চলা এই শিল্প এখন ব্যবহার হয় নানা প্রচার কাজেও। সরকারি স্তরে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে, আধুনিক সময়ের নানা ঘটনার কথা জানাতেও গম্ভীরা শিল্পের মাধ্যম ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত এই শিল্প।
যোগাযোগ ব্যবস্থা:
সড়ক (Road) ও রেল (Rail) পরিষেবার মাধ্যমে কলকাতা ও দেশের আরও নানা শহরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মালদা জেলা। মালদার সদর শহর ইংরেজ বাজারের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ রয়েছে। জেলার একেবারে বুক চিরে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক (NH34)। মালদার অনেক জায়গায় এটাই মূল রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ৮১ নম্বর জাতীয় সড়কও রয়েছে। যা বিহারের সঙ্গে মালদার যোগাযোগ করে। রাজ্যের একাধিক সরকারি পরিবহন সংস্থার বাস কলকাতা-মালদা (Kolkata-Malda Bus), শিলিগুড়়ি-মালদা (Siliguri-Malda Bus) যাতায়াত করে। অন্য জেলা শহরের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে একাধিক বেসরকারি বাসও। ইংরেজবাজার ও মালদা টাউন রেলপথেও যুক্ত। এর রেল ভিডিশনাল হেডকোর্য়াটর হল মালদা ভিডিশন (Malda Rail Division)। যদিও এই রেল ডিভিশন এলাকার অধিকাংশই বিহার ও ঝাড়খন্ডের (Jharkhand) অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার প্রায় সব ট্রেনই মালদা ছুঁয়ে যায়।
পর্যটন:
পুরাতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সৌধ ও মসজিদ রয়েছে মালদায়। বড় সোনা মসজিদ, দখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, চিকা মসজিদ, কদম রসুল মসজিদ, গুমটি দরওয়াজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও পান্ডুয়ার একলাখি মসজিদ রয়েছে। বাংলার অন্যতম প্রথম স্কোয়ার ব্রিক গম্বুজ এটি। রয়েছে রামকেলি গ্রাম। যেখানে বেশ কিছুদিন শ্রী চৈতন্যদেব বাস করেছিলেন বলা হয়। রয়েছে আদিনা ইকো টুরিজম পার্ক, মালদা মিউজিয়াম। মালদার হবিবপুর ব্লকের জগজীবনপুর (Jagjivanpur) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক এলাকা (an archeological site)। এই এলাকা থেকে পাওয়া গিয়েছিল একটি তাম্রপত্র। যেটি পাল বংশের সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের সমসাময়িক। সেখানে নবম শতকের বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসস্তূপও রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
1. www.malda.gov.in
2. www.wbnorthbengaldev.gov.in
3. www.maldapolice.wb.gov.in
4. www.nabard.org
5. www.maldazillaparishad.in
আরও পড়ুন: মরচে ধরা গা ছুঁয়ে আজও বয়ে যায় নদী, এককালের শিল্পশহর হাওড়া, ইতিহাস মনে রেখেছেন কেউ কি!