কলকাতা : তখন ষোড়শ শতকের শেষ কিংবা সপ্তদশ শতকের সূচনা। বাংলা তখন বর্গী আক্রমণে ত্রস্ত। দিল্লির মসনদে তখন সম্রাট আকবর। তাঁর আদেশে মানসিংহ আসেন বাংলায় বর্গী দমন করতে। এখানে এসে তাঁর পরিচয় ঘটে কামদেব ব্রহ্মচারীর সঙ্গে। সে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস। মানসিংহ কামদেব ব্রহ্মচারীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বলে শোনা যায়। কথিত আছে মানসিংহের হারানো ছেলেকে খুঁজে দেন তাঁর গুরু। তাঁর দক্ষিণা হিসেবেই ব্রহ্মচারীকে ১৬০৮ সালে ৯ টি গ্রামের জায়গীরদার প্রদান করেন মানসিংহ। কামদেব ব্রহ্মচারীর পুত্র লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় । তিনি বড়িশা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন । জানা যায়, সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে "রায়" ও জাহাঙ্গিরের থেকে ‘চৌধুরী’ উপাধি পান তাঁরা। ক্রমে ‘রায় চৌধুরী’ পরিবার বলেই তাঁরা পরিচিতি পান। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় থেকে এই পরিবার সাবর্ণগোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবার নামে খ্যাতি পায়। লক্ষ্মীকান্ত হালিশহরে অনেক মন্দির ও বাসস্থান নির্মাণ করেন । পরবর্তীতে বড়িশায় আসেন। সেখানে একটি বাড়িতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় রায়চৌধুরী পরিবার। 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওই পরিবারেরই বংশধর কালীকিঙ্কর এক ভবন নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে কালীকিঙ্কর  ভবন নামেই পরিচিত। এই সুবিস্তৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানালেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ৩৪ তম বংশধরের স্ত্রী, ওই পরিবারের পুত্রবধূ পত্রলেখা রায়চৌধুরী।  ১৮৮৪ সালে ওই বাড়িতে পুজো শুরু হয়েও পরে কোনও কারণে বন্ধ হয়ে যায়। শোনা যায়, সাবর্ণ রায়চৌধুরীর অন্যতম তালুক, যা অধুনা কার্জন পার্ক এলাকা নামে পরিচিত, তা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার পর পুজো সাময়িক বন্ধ হয়। এরপর আবার ১৯৬৫ সালে নতুন করে পুজো শুরু হয় এই ভবনে। যা অর্ধশতাব্দী পার করে ফেলেছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের পুজোগুলোর মধ্যে এই ভবনের পুজোর দালানই সবথেকে বড়। 


সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজো মোট ৮টি বাড়িতে হয়। তার মধ্যে আছে, আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, বেনাকি বাড়ি , মেজো বাড়ির পুজো, কালীকিঙ্কর ভবনের পুজো, মাঝের বাড়ি পুজো। এছাড়াও বিরাটি বাড়ি ও নিমতা বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে।
বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী রীতি-নিয়ম মেনে এখানে পূজিত হন দশপ্রহরধারিণী। পুজো হয় এক চালচিত্রে। তবে একই চালচিত্রের মধ্যে থাকে তিন ভাগ। মাঝে থাকেন সপরিবার মা দুর্গা। দুই পাশে থাকেন মহাদেব ও রামচন্দ্র। এটাই সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিমা গড়ার রীতি। সুপ্রাচীন কাঠামোতেই নতুন করে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়া হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর কাঠামো তুলে নেওয়া হয় জল থেকে। 

এই পরিবারের সন্ধিপুজোর একটি বিশেষত্ব রয়েছে। সদ্যস্নাতা পরিবারের সদস্যা ভিজে গায়ে, ভিজ কাপড়ে ভোগ রান্না করেন। মায়ের ভোগে থাকে ল্যাটা বা শোল মাছ। মাছ পুড়িয়ে মাখন মিশিয়ে নিবেদন করা হয় দেবীমূর্তির সামনে। এছাড়া সপ্তমী থেকে দশমী ১৮ টি ভাগে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় মা দুর্গাকে। মুখে কাপড় বেঁধে রান্না করতে হয় ভোগ। এই পুজোর বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত পুকুরেই হয়ে থাকে। পুজোর শেষে বাড়িতে তৈরি বোঁদে দিয়েই হয় দশমী পালন। দিন গড়িয়েছে, বছর গড়িয়েছে, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্যময় অতীত এখন লোকের মুখে মুখে ফেরে। এত বছর পার করেও বাড়ির পুজোর আত্মাটি রয়ে গেছে পুরাতনই। প্রতিবছর তাতে লাগে নতুন মাটি, নতুন রঙ। নতুন সদস্যরা আসেন পরিবারে। কিন্তু বাড়ির রীতি মেনেই পুজোয় যুক্ত হন তাঁরা । আধুনিকতার রং তাতে এখনও লাগেনি।