অমিত জানা, নারায়ণগড় : ১২২ বছরের পুরনো পুজো। কামান দেগে দেবীর বোধন হতো নারায়ণগড়ের (Narayangarh) গড় কৃষ্ণপুর গ্রামের দেববাড়ির পুজোয় (Puja)। প্রথামতো মূর্তিপুজো বন্ধ হয়ে গেলেও, এখনও ঘটপুজোর মাধ্যমে আনন্দে মেতে ওঠেন এই পরিবারের সদস্যরা। শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় পুজো।


পুজোর ইতিহাস-


ষোড়শ শতকের শেষের দিকে বাংলার সুবেদার মান সিংহের আমলে রাজস্থান থেকে বাংলায় এসেছিল দেও পরিবার। বাস করত বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড় থানার গড় কৃষ্ণপুর গ্রামে। পরবর্তী সময়ে জমিদারি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে এলাকায় প্রায় ৫০-টি মৌজার অধিকার সত্ত্ব লাভ করে তারা।‌ ততদিনে দেও থেকে 'দে' হয়ে 'দেব' উপাধি গ্রহণ করেছে এই পরিবার। ইংরেজ সরকার দিয়েছিল চৌধুরী উপাধিও।


কালক্রমে জমিদারিতে বসবাসকারী প্রজাদের কল্যাণ কামনায় ১২৯১ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৮৪ সালে গড় কৃষ্ণপুরে গোলক মোহন ও রাধা মোহনের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেব পরিবার। মন্দিরের কাজ সমাপ্ত হয় ১৩০৮ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯০১ সালে।


কথিত আছে, এক ব্রাহ্মণ সাধু গড়কৃষ্ণপুর এই জমিদার বাড়িতে বেশ কিছু সম্পত্তির কাগজ জমা দিয়ে জমিদার পরিবার থেকে অর্থ ধার নিয়েছিলেন । জমিদার বাড়ি থেকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, টাকা পরিশোধ করতে হবে আগামী পূর্ণিমার সূর্যাস্তের আগে। তিনি পূর্ণিমার সূর্যাস্তের আগে টাকা পরিশোধ করে জমির কাগজ নিয়ে যেতে এলেও নিয়ে যেতে পারেননি। সূর্য তখন অস্তমিত। দেব পরিবার ওই ব্রাহ্মণ সাধুকে তাঁর জমির কাগজ না দিয়েই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ওই ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিয়ে গেছিলেন জমিদার বাড়ির লোকেদের। আর সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের পথ হিসাবে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয় পরিবার। সেই থেকেই গোলক মোহন মন্দিরে পাশেই শুরু হয় মাতৃ আরাধনা বা দুর্গাপুজো। ডাকের সাজে দুর্গা প্রতিমার বোধন হতো কামান দেগে। রীতি ছিল, জমিদারি বাড়ি থেকে হাতি যেত পুরোহিতকে আনতে। হাতির পিঠে চড়েই পুরোহিত আসতেন জমিদার বাড়িতে দেবীর দুর্গার পুজো আরাধনা করতে।


জাঁকজমকপূর্ণ এই পুজোর পাঁচদিন প্রজাদের অন্নভোগ বিতরণ করা হতো। জমিদার বাড়ির মূল ফটকে পুজোর কয়েকটা দিন বসত নহবত। কালের নিয়মে জমিদারি যায় ধীরে ধীরে। আর্থিক অনটন শুরু হয় দেব পরিবারে! দুর্গাপুজোও ধীরে ধীরে জৌলুস হারাতে শুরু করে। ১৯৬৯ সাল থেকে মূর্তি পুজো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঘটের উপর পিতলের মূর্তি স্থাপন করে পুজো শুরু হয়। গত ৫৩ বছর ধরে কিছুটা অনাড়ম্বর, তবে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে নারায়ণগড়ের গড় কৃষ্ণপুরের দেব পরিবারে। গ্রামের বাসিন্দারা এখনও শতবর্ষ প্রাচীন এই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। দূর দূরান্ত থেকে আসেন আত্মীয়-পরিজনেরা। তবে, জমিদারি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুজোর খরচ কিংবা আড়ম্বরের বহর কমেছে। জরাজীর্ণ মন্দির কিংবা দুর্গা দালান এখন কেবল দেব পরিবারের জমিদারির সাক্ষ্য আর পুজোর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।


দেব পরিবারের সদস্য দীপক দেব বলেন, পূর্ব পুরুষের থেকে এই পুজো চলে আসছে। হাতির পিঠে চাপিয়ে পুরোহিতকে নিয়ে আসা হত এবং তাঁকে বাড়িতে আবার পৌঁছে দিয়ে আসা হতো। ডাকের সাজে মাকে সাজানো হতো। বিভিন্ন মৌজা থেকে লোকজন এলে কাছারি বাড়িতে থেকে খাওয়া-দাওয়া করতেন। যাত্রা শুনে বাড়ি ফিরতেন সকলে। ১৯৬৯ সাল থেকে আমাদের প্রতিমা পুজো বন্ধ হয়ে যায় । এরপর মূর্তির মুখ বসিয়ে আমরা পুজোটা চালু রেখেছি।


পরিবারের আরেক সদস্যা শিখা দেব বলেন, আমি এই বাড়িতে গৃহবধূ হয়ে আসার পর আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে শুনি, রীতিনীতি মেনেই এই পুজো হতো। জমিদারি বাড়ির কামান দেগে ঘট উত্তোলন হত। বাড়ির সমস্ত সদস্যরাই এই পুজোর সময় উপস্থিত হন। মূর্তি পুজোটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ঘটপুজোটার মাধ্যমে সকলেই আনন্দ করি।


আরও পড়ুন ; প্রকৃতির উপর মানুষের আগ্রাসন, সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে থিমে অভিনবত্ব বেহালার দেবদারু ফটকের পুজোয়