শাল্মলি বসু, কলকাতা: আশ্বিনের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। কিন্তু পুজোর উন্মাদনায় ঘাটতি নেই। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। অপেক্ষা শুধু মা-এর আগমনের। শহর পেরিয়ে গ্রাম, বঙ্গজুড়েই একই ছবি। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে রামপুরহাট। সেখানেই চাঁদপাড়া গ্রাম। আর কদিন পরই সন্তানদের নিয়ে পাড়ি দেবেন মা দুর্গা (Durga Puja 2023)। কাটা চালিতেই প্রতিমার আরাধনার প্রস্তুতি। দশভুজে নয়, পার্বতী তাঁর সন্তানদের আগলে রাখেন চতুর্ভুজেই।
পুজোর ইতিহাস: ঢাকের তালে উৎসবের-সুর। আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ ভরপুর। বীরভূমের (Birbhum) রামপুরহাট ব্লক ২-এ এই চাঁদপাড়া গ্রাম। এই পুজো চৌধুরী বাড়ির পুজো বলেই পরিচিত গ্রামে। প্রায় ৪০০ বছর আগে শুরু মা দুর্গার আরাধনা। উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তমানে ঘোষ পরিবার এবং চৌধুরী পরিবারের একাংশের হাতেই রয়েছে এই পুজোর দায়িত্ব। গ্রামে মোট ১১টা বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। তার মধ্যে ৯টা পুজোয় মূর্তি থাকে। বাকি দুটোয় রয়েছে ঘট পুজোর রীতি। ঘোষ পরিবারের সদস্য সুদীপ্ত ঘোষ বলেন, “এই পুজো হল আমার দাদুর মামার বাড়ির পুজো। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা এখন এই পুজো করছি।’’
কাটা চালিতে অধিষ্ঠিত মা দুর্গা। বছরের পর বছর ধরেই চলে আসছে এই রীতি। কেন এই নিয়ম? সুদীপ্ত ঘোষ বলেন, “দুর্গা প্রতিমার চালি পুরো নেই। শোনা যায়, কোনও এক সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে পুরো চালি করার রীতি আর নেই। সেই নিয়ম মেনেই আমরা পুজো করছি।’’ মা দুর্গা দশভূজা হলেও এই পুজোয় নিয়ম কিছুটা ভিন্ন। চতুর্ভূজাকেই আরাধনা করা হয়।
প্রতিমার গড়নেও রয়েছে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। বাড়ির মন্দিরেই তৈরি হয় ঠাকুর। প্রতিবছর রথের দিনই পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে যায়। সেদিন থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। বোধন থেকে বিসর্জন, প্রতি ক্ষেত্রেই রয়েছে অভিনবত্বের ছোঁয়া। তিথি মেনে নবমীর ১৫ দিন আগে হয় বোধন। সেদিন থেকে শুরু কল্পারম্ভ। রয়েছে পাঁঠাবলির রীতি। বোধনের জন্য একটা ঘট আনা হয়। সেই ঘটেই শুরু হয় পুজো। এরপর ১৫ দিন এই ঘটেই হয় নিত্যপুজো। ষষ্ঠী থেকে হয় মূল পুজোর সূচনা।
শাক্ত মতে পুজো হয়। প্রত্যেক শরিকের নামে সংকল্প হয়। মূলত ষষ্ঠীর পুজো হয় সন্ধেবেলা। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়মটা ভিন্ন। ষষ্ঠীর রাত পেরিয়ে ভোরের দিকে হয় এই পুজো। এরপর হয় নবপত্রিকা স্নান। গ্রামে যে কটা বাড়িতে পুজো হয়, প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে এই নবপত্রিকা স্নানে অংশ নেন। বোধন ছাড়াও পুজোর বাকি দিনগুলিতেও পাঁঠাবলি দেওয়ার রীতি রয়েছে। পাশাপাশি দেওয়া হয় সাত মণ আতপ ভোগ। সারাবছর না হলেও, পুজোর সময় কদমা তৈরি হয়। প্রতিদিনই থাকে লুচি ভোগ। অষ্টমীর দিন অন্ন খাওয়ার নিয়ম নেই। সুদীপ্ত ঘোষ জানান, “বোধন তো বটেই সপ্তমী, সন্ধি এবং নবমী পুজোর সময়ও পাঁঠাবলি হয়। আতপ চাল, বাতাসা, মন্ডা দিয়ে তৈরি হয় ভোগ। অষ্টমীর দিন অন্ন খাওয়া হয় না। মূলত মেয়েরাই পালন করে এই রীতি।’’
সব শেষে বিসর্জনেও রয়েছে মিলনের সুর। দশমীতে পঞ্জিকা মেনে হয় দর্পণ বিসর্জন। এরপর গ্রামের ৯টা বাড়ির পুজোর বিসর্জনকে কেন্দ্র করে কার্যত মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে চাঁদপাড়া। প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে আগে গ্রামের মধ্যেই হয় জমকালো শোভাযাত্রা। এরপর গ্রামেরই এক পুকুরে একে একে হয় প্রতিমা নিরঞ্জন। মা দুর্গা চলে গেলেও, এক সুতোয় বেঁধে রেখে যান তাঁর সন্তানদের।
আরও পড়ুন: Durga Puja 2023: ৩০০ বছর ধরে নিমকাঠের প্রতিমার আরাধনা, বিষ্ণুপুরে উগ্রচণ্ডা রূপে পূজিত হন দশভূজা