কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: এক সময় লোকজন-পাইক-বরকন্দাজে গমগম করত এই রাজবাড়ি। বাহিরমহল-অন্দরমহলে নানা লোকজন। তুমুল ব্যস্ততা। আর এই ব্যস্ততা আরও বেড়ে যেত পুজো এলে। বর্ধমান (Purba Bardhaman) রাজবাড়িতে তখন তিলধারণের জায়গা থাকত না। রাজবাড়ির পুজোর ইতিহাস নিয়ে এমনটাই বলেন পুরনো স্থানীয় বাসিন্দারা।
বাংলায় অধিকাংশ দুর্গাপুজোই (Durga Puja) চারদিন ধরে হয়। কিন্তু বর্ধমান রাজবাড়ির (Bardhaman Rajbari) একটি বিশেষত্ব রয়েছে। এখানে দশদিন ধরে পূজিতা হন দেবী দুর্গা। মহালয়ার পরেরদিন থেকেই বর্ধমান রাজবাড়ির মন্দিরে শুরু হয় দুর্গাপুজো। প্রাচীন আমল থেকেই এই রীতি চলে আসছে। এখনে পটে পূজিতা হন দেবী দুর্গা। অর্থাৎ প্রতিমা নয়, পটে আঁকা দেবী দুর্গার ছবিকে পুজো করা হয়। এটাও বর্ধমান রাজবাড়ির পুজোর বিশেষত্ব। যা এখনও চলছে। পুজোর সময় রাজপরিবারের বংশধরেরা উপস্থিত থাকেন।
একসময় জৌলুস থাকলেও কালের নিয়মে সেসব হারিয়ে গিয়েছে। রাজাও নেই, রাজবাড়িও ভগ্নপ্রায়। বেঁচে আছে শুধু রীতি আর নিয়ম, যা মেনেই আজও পুজো পান দেবী দুর্গা। রাজবাড়ির নাট মন্দিরও ভগ্নপ্রায়। পলেস্তারা খসে পড়েছে, বেরিয়ে পড়ছে ইট। তারমধ্যেই হয় পটেশ্বরী দুর্গাপুজো। বর্ধমানের মহারাজার হাতেই তৈরি হয়েছিল লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ-এর মন্দিরে। বলা হয়, একসময় পুজো দেখতে নানা জায়গা থেকে ভিড় জমাতেন বহু মানুষ। দামোদর পেরিয়ে আসতেন অনেকে, পায়ে হেঁটে-গরুর গাড়িতে করে এসে ভিড় জমত মন্দিরের আশপাশে। কথিত রয়েছে, এই রাজ পরিবারের একটি প্রথা ছিল। রাজ পরিবারের মহিলারা সর্বসমক্ষে আসতেন না। রাজবাড়ি থেকে মন্দিরে আসার জন্য় তাঁদের জন্য গোপন রাস্তা ছিল। মন্দিরের দোতলায় একটি জায়গা করা ছিল যেখানে বলে রাজপরিবারের মহিলারা পুজো দেখতেন। কিন্তু মন্দিরে আসা বাকিরা তাঁদের দেখতে পেতেন না।
কথিত রয়েছে,পটেশ্বরী দুর্গাপুজো শুরু করেন বর্ধমানের তৎকালীন মহারাজ মহাতাব চাঁদ। সময়টা, আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে। দেবী দুর্গা এখানে শালকাঠের কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। কাঠের কাঠামোর উপর নানা রং দিয়ে নিপুণ তুলির টানে তৈরি হয় দশভুজার একচালার পট। এখানে একমাত্র গণেশ ছাড়া দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং অসুরের মুখের ছবি এমন ভাবে আঁকা আছে যেখানে শুধুমাত্র একটি চোখ দেখা যায়। মা দুর্গার বাহন সিংহের জায়গায় আঁকা আছে ঘোড়ার ছবি। ১২ বছর অন্তর একবার রঙ করা হয় পটেশ্বরী দুর্গার। রাজ-আমলের রীতি মেনেই লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে মহালয়ার পরের দিন থেকে দুর্গাপুজো শুরু হয় আজও। এখানে বলি প্রথা ছিল, তবে কোনও প্রাণী নয়, রাজাদের আমলে সুপারি বলি হতো। এখন অবশ্য কোনও বলি হয় না। নবমীর দিন পটেশ্বরীর সামনে নবকুমারী পুজো হয়। এই মন্দির (Temple) প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে পাশের একটি মন্দিরে দেবী পূজিতা হতেন। পরে মহারাজ মহাতাব চাঁদ এই মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরের সামনেই নাটমন্দির। দশদিন ধরে গুজরাটি সম্পদায়ের মানুষজন এসে নাটমন্দিরে ডাণ্ডিয়া নৃত্য প্রদর্শন করেন। সেই রীতি এখনও চালু আছে। কিন্তু নাট মন্দিরের ভগ্নদশার কারণে মূল মন্দির প্রাঙ্গনে হয় ডাণ্ডিয়া নাচ। পুজোর ভোগ প্রসাদেও আছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য, অষ্টমী ও নবমীর দিন ছোলা,হালুয়া,পুরীর ভোগ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: অগ্নিযুগের স্মৃতি বুকে নিয়ে ধ্বংসস্তূপ রাজবাড়ি! এখনও নিষ্ঠাভরে হয় দুর্গাপুজো