প্রকাশ সিন্হা, ভাস্কর মুখোপাধ্য়ায় ও সোমনাথ মিত্র, কলকাতা : একা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (Jyotipriyo Mallick) নন, রেশন দুর্নীতিতে (Ration Distribution Scam) যুক্ত তাঁর স্ত্রী ও মেয়েও ! শুক্রবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বনমন্ত্রীকে পেশ করে এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করল ইডি। বিচারক বলেন, আমার কাছে এটা আশ্চর্যের যে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রীর সম্পত্তি কী করে একবছরে ৪৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৬ কোটি টাকা হয়ে গেল ?


শুধুমাত্র জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই নন, রেশন দুর্নীতিতে যুক্ত তাঁর স্ত্রী ও মেয়েও ! শুক্রবার আদালতে এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করল ইডি ! রেশন দুর্নীতি মামলায় প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী ও বনমন্ত্রী জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিককে গ্রেফতারির পর শুক্রবার আদালতে ইডির আইনজীবী দাবি করেন, ২০১৫-১৬ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হলফনামায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর স্ত্রীর অ্য়াকাউন্টে থাকা টাকার হিসেবে দেখান ৪৫ হাজার টাকা ! ইডি সূত্রে দাবি, পরের বছরই দেখা যায় সেই টাকার অঙ্ক গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি কোটি ! আদালতে ইডির আইনজীবী দাবি করেন, জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিক নিজের বাড়ির পরিচারক থেকে রাঁধুনির নামে কোম্পানি খুলেছিলেন। ইডির আইনজীবী বনমন্ত্রীর স্ত্রী ও মেয়ের কথা উল্লেখ করে দাবি করেন, তাঁদের বাড়িতে এমন সিল ও স্ট্যাম্প পাওয়া গেছে, যে কোম্পানির নামই পরিবার জানে না বলে দাবি করেছে।


ইডি সূত্রের দাবি, এবিষয়ে জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, স্ত্রী জানেন, স্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন জ্য়োতিপ্রিয় জানেন। বিচারক বলেন, ওঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন না। মেয়ে তো শিক্ষিত। ওঁকে কেউ সই করতে বলল, উনি করে দিলেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

এদিন আদালতে ED দাবি করে, মূলত তিনটি সংস্থার মাধ্যমে খোলা বাজারে রেশন সামগ্রী বিক্রি করা হত। এই তিনটি সংস্থা হল - Shree Hanuman Realcon Pvt Ltd, Gracious Innovative Pvt Ltd এবং Gracious Creation Pvt Ltd। এই সংস্থাগুলি বাকিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই তিনটি কোম্পানির নামে ১২.০৬ কোটি টাকার ভুয়ো Security Premium দেখানো হয়েছে। এই তিনটি অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮ কোটি টাকা জমা হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ নগদে জমা দেওয়া হয়েছে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মেয়ে এবং স্ত্রী ছিলেন এই তিনটি সংস্থার ডিরেক্টর। এই তিনটি সংস্থার অ্য়াকাউন্টে শস্য বিক্রির টাকা জমা পড়েছিল। পরে দেখা যায়, এই তিনটি সংস্থাই বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রায় ২০.২৪ কোটি টাকা বাকিবুর রহমানের এক আত্মীয়র ব্যাঙ্ক অ্য়াকাউন্টে জমা পড়ে। পরে এই টাকা Ms. AJ Agrotech এবং Ms. AJ Royal বলে দু'টি কোম্পানির অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। নভেম্বর ২০১৬ থেকে মার্চ ২০১৭-র মধ্যে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রীর ব্যাঙ্কে ৬ কোটি ৩ লক্ষ টাকা এবং মেয়ের অ্যাকাউন্টে ৩ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা জমা পড়েছিল। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পরিবারের ভ্রমণের জন্য প্লেনের টিকিটও বুক করেছিলেন বাকিবুর রহমান, যদিও পরে তা বাতিলও করা হয়।


এপ্রসঙ্গে আইএসএফ বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি বলেন, 'সাম্রাজ্য়ের রাশ কার হাতে থাকবে, কাদের হাত থাকবে এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। সে জন্য় কারও রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য়, যাঁরা প্রভাবশালী আছেন, যাঁরা প্রভাবিত করতে পারেন, তাঁর দলেই, তাঁদেরকে মনে হয় আস্তে আস্তে গ্য়ারেজ করা হচ্ছে। একপ্রকার ষড়যন্ত্র করে নয়, দুর্নীতি করেছে, দুর্নীতিমুক্ত এঁরা নন, সেটাকে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। তবে আমি একটা কথা বলে রাখি, ফিরহাদ হাকিমেরও সময় আর বেশি নেই বলে আমার মনে হচ্ছে। তাঁর দলের মধ্য়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।'

এদিন আদালতে বিচারক জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিককে প্রশ্ন করেন, গ্রেফতার করার কারণ কি জানানো হয়েছিল আপনাকে ? উত্তরে মন্ত্রী বলেন, একটা কপি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আমি জানি না। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কাছে বিচারক জানতে চান, আপনাকে শারীরিক বা মানসিক অত্য়াচার করা হয়েছিল ? বিচারক বলেন, একজন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াকে অত্যাচারের কথা বলেছিলেন। তাই জানতে চাইছি। উত্তরে জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, না কোনও অত্য়াচার করা হয়নি। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী এরপর একটি আমেরিকা যাত্রার টিকিটের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী ও বৌদির আমেরিকা যাওয়ার ছিল। পরে সেই টিকিট বাতিল করা হয়। এতে দুর্নীতির কী আছে বুঝতে পারছি না ?


এই ইস্যুতে সুর চড়িয়েছেন সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, 'এখনও পর্যন্ত মেয়ের নামে ২০টি কোল্ড স্টোরেজ, ১০টি রাইস মিল। কেবলমাত্র টিউশন করে ব্যাঙ্কে জমানো টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৩৭ লক্ষ। আদর্শ। সমস্ত বেকার যুবক-যুবতী, যাঁরা হাজার দিন ধরে ধর্না দিচ্ছেন, তাঁদের গিয়ে টিউশন করে টাকা উপার্জনের উপায়টা শেখাতে পারতেন।'


বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেন, 'তাঁর কন্য়া প্রাইভেট পড়িয়ে ৪ কোটি টাকা ইনকাম করেছেন, বিশ্বজগতে আমি প্রথম শুনতে পেরেছি। মানুষ তো সবকিছু ছেড়ে সবার আগে প্রাইভেট পড়াবে তাহলে। আমিও আমার মিনিস্ট্রি ছেড়ে দিয়ে কাল থেকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করব, যদি ৪ কোটি টাকা ইনকাম করতে পারি।'

নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্য়ায়ের একটি বাড়ির হদিশ মিলেছিল শান্তিনিকেতনে। তার থেকে মাত্র দেড় কিমি দূরে শান্তিনিকেতনের রতনপল্লিতে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মেয়ে প্রিয়দর্শিনী মল্লিকের একটি বাড়ির হদিশ মিলেছে। বাড়ির নাম- দোতারা। সূত্রের দাবি, এই বাড়িও এখন ইডির নজরে।

স্থানীয় সূত্রে দাবি, ২০২০ সালে ৮০ লক্ষ টাকা দিয়ে রতনপল্লির বাসিন্দা হিমাংশু সেনগুপ্ত কাছে থেকে এই বাড়িটি কেনা হয় ৷
পরে প্রায় সমপরিমাণ টাকা দিয়ে বাড়িটি সংস্কার করা হয়। বর্তমানে বাড়িতে কেয়ারটেকার থাকলেও ভিতর থেকে তালা বন্ধ।


৫ নভেম্বর অবধি জ্য়োতিপ্রিয় মল্লিকের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।