উত্তরায়নের পথে ত্রিবেণী সঙ্গম। ত্রিবেণী-তিন নদীর মিলন। তিন-কূল মিলে যেন ভবিষৎদ্রষ্টা হয়ে উঠেছে। বজরা চলেছে ত্রিবেণী সঙ্গমে, উত্তরায়নের পথে । বজরা  যেন আবহমান কালের প্রতীক। যাত্রীরা এক এক যুগে এক এক জন। কালের বজরা  চলতেই থাকে। 


এ নদীর বহমানতা সেই অতীত কাল থেকে। উজান ও ভাটা- জীবনের ওঠা-পড়ার মতো চক্রাকারভাবেই বয়ে চলেছে নদীর প্রবাহ। কখনো সমুদ্রের লীন হয়ে যাওয়ার পথে, কখনও বা সমুদ্র থেকে ছাড়িয়ে অনেক দূর, আরও দূর, নদীর উৎসের দিকে এগিয়ে যাওয়া। নদীর ধারের ঘাটগুলি সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর সন্ধের অন্ধকারে নিঝুম হয়ে মনে করে পুরনো যুগের  আদি-অন্ত কাহিনির কথা। যে কাহিনি কিছু জানা, কিছু বা থেকে গেছে অজানা।  নদীর কাছে কোনও কিছুই লুকানো নয়।  যুগ যুগ ধরে এই পথে চলতে চলতে সে প্রত্যক্ষ করেছে জীবন মৃত্যুর নিত্য নাটের খেলা।  সব কিছুরই সাক্ষী এই নদী তীর।  নদী তীরের অশ্বত্থ বটের ঝুরি। উত্তরে নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে তার থেকে একটু দূরে ত্রিবেণী সঙ্গম। 


এ ত্রিবেণী প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী নয়, এ ত্রিবেণী মুক্তবেণী ; গঙ্গা-যমুনা ও অন্তঃসলিলা সরস্বতী নদীর মিলন। বর্তমানে হুগলি জেলায় বাঁশবেড়িয়া থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। ত্রিবেণীর পথে যাতায়াত বহু যুগ ধরে।  ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নানে পুণ্য অর্জন। কত স্মৃতি কত ইতিহাস কত নিষ্ঠুরতার কত দুঃখের কাহিনি নদীর কূলে নৌকার বৈঠার সঙ্গে মিশে গিয়ে ছড়ানো ছেটানো রয়েছে আশপাশে।


 





একনজরে মন্দির ভ্রম
গাছপালার সীমানা ছাড়িয়ে প্রান্তরের শেষে চোখে পড়ে মন্দিরের চূড়া। এ কি  দক্ষিণেশ্বরের  ভবতারিণী মন্দির ? এক নজরে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। অনেকটাই দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মত। তারই আদলে তৈরি অন্য একটি মন্দির। গঙ্গার পূব তীরে অবস্থিত মন্দিরের গঠন অনেকটাই দক্ষিণেশ্বরের আদলে এবং সেটাই হওয়া হয়তো খুবই স্বাভাবিক। 


 





বাগের মোড়। চার মাথার মোড়ে রানি রাসমণির পূর্ণাবয়ব মূর্তি। এর আশেপাশেই ছিল তাঁর সাধের জন্মস্থান।  মোড় ছাড়িয়ে  একটি রাস্তা চলেছে গঙ্গার দিকে। সরু রাস্তার দুদিকে গজিয়ে ওঠা বসতি। সে পথে চলতে চলতে দু'ধারে ঘন বসতির দিকে নজর রাখার সময় মনে হল, এদেরই মধ্যে কোন এক হারিয়ে যাওয়া মাঠ, গাছতলা, পুকুর নিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ঘটনা প্রবাহ, এত বছর পর যার সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।  কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে কত কাহিনি, কত চিহ্ন।  শুধু জায়গার নাম ধরে রেখেছে ঘটনার প্রমাণ হিসাবে।  বাগের মোড় থেকে হুগলি নদীর কূলের দিকে ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে  খোলা প্রান্তরে এসে  যেন চোখের মুক্তি ঘটল। বিশাল খোলা প্রান্তর, গাছপালা ভরা, একদিকে বয়ে চলেছে হুগলি নদী, যা গঙ্গা নামেই ডাকা হয়। নদীর তীরে দূর থেকে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া। রানি রাসমণি ঘাট নামে পরিচিত এই স্থান 
নদীর একদম গা ঘেঁষে। ঢালাই রাস্তা। আর তার পাশেই মন্দির। বর্ষার সময় নদীর দু’কূল ছাপিয়ে জল উঠে আসে মন্দিরের গোড়া পর্যন্ত।  সে কারণেই হয়তো মাতৃ মূর্তির স্থাপন করা হয়েছে মন্দিরের দ্বিতল কক্ষে। নিচের তলটা অনেকটাই খোলামেলা রাখা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ। ভিতরে মাকালীর বিগ্রহ। কষ্টিপাথরে গড়া মায়ের মুখ। দক্ষিণমুখী স্থাপিত মা এখানে দক্ষিণা কালী
রূপে বিরাজিত।  নিত্যপুজো ছাড়াও এখানে বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও আছে। 


 





মন্দিরের অজানা কাহিনি


মন্দিরের অন্যতম প্রধান সেবাইত স্বামী বামদেবানন্দজি মন্দির প্রাঙ্গণে বসে বলছিলেন রানি রাসমণি ঘাট ও মাতৃমন্দিরের ইতিহাস। যার অনেকটাই অজানা ছিল এতকাল। এ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ বা তথ্যাদি এখনো পুরো সংগ্রহ করে ওঠা যায়নি। মন্দির প্রতিষ্ঠা ও তারপরে বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডের সাক্ষী অনেকে। মন্দিরের গায়েই গড়ে তোলা হচ্ছে আরেকটি উপাসনা স্থল। সেটা বেলুড় মঠের আদলে।  যাতে গঙ্গার দু’পাড়ের আলাদা থাকা বেলুড় মঠ ও দক্ষিণেশ্বর মন্দির দূরত্ব ঘুচিয়ে তা একই অঙ্গে বিরাজ করবে এখানে।


স্বামী বামদেবানন্দজি বলছিলেন রানি রাসমণির জীবনের এক অজানা ঘটনা। তখনো দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়নি। সেবার রানি রাসমণি উত্তরায়নের শুরুতে গেলেন ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নানের উদ্দেশ্যে।  রানির পৈত্রিকগৃহ হালিশহরের কোনা গ্রাম ত্রিবেণীর খুব কাছেই।  বহুবছর নিজের ভিটেমাটির দর্শন হয়নি রানির।  হবেই বা কী করে ! জানবাজার জমিদার বাড়ির হাজারটা কাজের মধ্যে আর সময় কুলিয়ে উঠতে পারেন না।  আর পৈতৃক ভিটেতে এখন আর কেউ নেই।  বাবা মা গত হয়েছেন বহুকাল। ভিটেতে  বাড়ির অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ভাঙা কুঁড়েঘরখানি যে কবে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে তার কোনও হাল-হদিশ পাওয়া যায় না। পিতৃভূমিতে ফিরলে তো কোথাও একটা উঠতে হবে। সে কারণে আগে লোক পাঠিয়ে কোনা গ্রামে কয়েকদিন থাকার মত ঘরের ব্যবস্থা করলেন রানি। ইচ্ছা, তিনরাত্রি কাটিয়ে জানবাজারে ফিরবেন।


বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে। রাসমণির বজরা কলকাতা থেকে  এসে পৌঁছাল হালিশহরের কোনা গ্রামে। গঙ্গার তীরে গ্রামটিতে লোকজন খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রামে মগ্ন।  বজরা থেকে ধূলি ধূসর পথে নেমে এলেন রানি। বহু বছর পর নিজের গ্রামে ফেরা। হালিশহরের কোনা গ্রামের সেই ছোট্ট মেয়েটির কত স্মৃতি কত আনন্দের সাক্ষী চারদিকে। গঙ্গা নদী ও তার তীরের মানুষজনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবনের এক যুগ। ছেলেবেলার সঙ্গীরা কে কোথায় আছে, কে জানে !


 






রানি এসেছেন তাঁর নিজের গ্রামে। এ রানি এসেছেন জানবাজারের রানি হিসেবে নন, কোনা গ্রামের সেই ছোট্ট রানি মেয়েটি।  যে বহু বছর পর ফিরে এসেছে তার পিতৃ-ভিটেয়।  রানি আসার কথা শুনে গ্রামগঞ্জের লোক উজাড় করে এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে।  এসেছে তার ছেলেবেলার সঙ্গীরা, যাদের আশপাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছিল।  রানিও প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন।  প্রত্যেকের জন্য উপহার ফলফলাদি মিষ্টি এবং অর্থ সাহায্য করতে কার্পণ্য করেননি।  কিন্তু এই ভিটেয় এসে রানির মনে হয়েছিল, এবার নিজের  গ্রামের জন্য কিছু করা দরকার। প্রথমেই মনে আসে এক মন্দির স্থাপনের কথা। মাকালীর মন্দির স্থাপন করলে তা গ্রামের পাঁচটা লোকের যেমন উপকার হবে তেমনি তৃপ্ত হবেন রাসমণি।  



কিন্তু মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা তো মুখের কথা নয়। মন্দিরের সঙ্গে মায়ের নিত্য সেবারও আয়োজন করতে হবে।  তাতে যেন একদিনের জন্য বাধা না পড়ে। রানি জানতেন, তিনি চিরকাল ইহজগতে থাকবেন না।  তাঁর অবর্তমানে মন্দিরের নিত্যপুজো ও সেবায় যাতে কোনও ছেদ না ঘটে তার ব্যবস্থাও করে যেতে হবে। এক কথায়, কোনও মন্দিরের সঙ্গে তার সেবা ধারাবাহিকভাবে চলার জন্য যে অর্থের দরকার তার ব্যবস্থা সেই মন্দির সংলগ্ন দেবত্ব জমিতে করে রাখতে হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে সংলগ্ন জমিতে  মন্দিরের নিত্য সেবার উপাদান উৎপন্ন করার ব্যবস্থার জন্য বাপের বাড়িতে এসে রানি রাসমণি সেখানকার জমিদারের কাছে হাজির হলেন।  অনেক আশা নিয়ে জমিদারের কাছে পঞ্চাশ বিঘা জমি চাইলেন মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। তবে তা বিনামূল্যে নয়,  রীতিমতো কাঞ্চন মূল্যে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন গ্রামের জমিদারের কাছে। জমিদার প্রথমে জমি দিতে রাজি হলেও পরে বেঁকে বসলেন।  তাঁর আশঙ্কা ছিল,  জানবাজারের রানি মন্দির করার ছলে  টাকা ছড়িয়ে তার পুরো জমিদারি গ্রাম কিনে নেবেন।  জমিদারের আশঙ্কায় ইন্ধন জোগায় তারই কিছু কু-পরামর্শদাতারা। 


প্রথমে মন্দির করার নামে পঞ্চাশ বিঘে জমি নিয়ে তা দেবোত্তর করার পর ক্রমশ পুরো গ্রামটাই গ্রাস করবে রানি।  এমনটাই যুক্তি ছিল জমিদারের মাতব্বরদের। জমিদার বাড়িতে রানি অপেক্ষা করে রয়েছেন জমিদারের সিদ্ধান্ত জানার আশায়।  নিজের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুপুরের খাবার মুখে তুলবেন না। এমনই স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত বেঁকে বসলেন হালিশহরের জমিদার।  মন্দিরের জমি হবে না। রানি হলেও জাতে নীচু বিধবা মহিলাকে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া যায় না। একমাত্র উচ্চবর্ণের অধিকার আছে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। জানবাজারের রানিকে ভরা সভার মধ্যে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন অহংকারী জমিদার। শুদ্রের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে  পা রাখবেন না কোনও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ।  এমনটাই মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন কোনা গ্রামের জমিদার। 


অপমানিত রানি মাথা নিচু করে ফিরে গেলেন জানবাজারে। না, অর্থ বা ক্ষমতাবলে বাপের বাড়ির জমিদারের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেবার কথা মনেও আনলেন না তিনি। হয়তো এটাই ছিল মায়ের ইচ্ছা বা ভবিতব্য।  জানবাজারে ফিরে মন থেকে মুছতে পারলেন না মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মায়ের বিগ্রহ স্থাপনের কথা।  পিতৃভূমিতে না হলেও অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে গঙ্গার পূর্বকূলে দক্ষিণেশ্বরে প্রতিষ্ঠা করলেন মা ভবতারিণীকে। সেটা ১৮৫৫ সাল।  মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কয়েক বছর পর দেহ রাখলেন রানি রাসমনি। ১৮৬১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। নিজের জন্মভূমিতে মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন রয়ে গেল অপূর্ণ।  


রানির মৃত্যুর পর কেটে গেছে প্রায় এক শতক। লোকমুখে কথিত, রাসমণির বাপের বাড়ি হালিশহরের তিন গ্রামের তিন ব্যক্তি হঠাৎ প্রায় একই সময়ে পেলেন মায়ের স্বপ্নাদেশ।  মা কালী তাঁদের আদেশ দেন, গঙ্গার পূর্ব পাড়ে মায়ের মন্দির স্থাপন করে মাকে প্রতিষ্ঠা করতে। কেউ পেলেন জমি কেনার আদেশ, কেউ মন্দির করার, কেউ বা মাতৃমূর্তি স্থাপন করার।  প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ব্যক্তি। কেউ কারও পরিচিত নয়।  এমনকী এই তিনজন একই এলাকার বাসিন্দাও নন।


এক কথায় বলা চলে অলৌকিক কান্ড !  কোনও এক অনুষ্ঠানে সেই তিন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমন্ত্রণ পেয়ে এক দুপুরে সমবেত হলেন । দুপুরে আহারের পর ঘরোয়া খোসগল্পে মেতে উঠলেন আগত ব্যক্তিরা।  সেই সময় কথার ছলে এক ব্যক্তি তাঁর মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা খুলে বললেন। তার কথা শেষ হতে না হতে অপর দু’জন কাঁপতে কাঁপতে প্রথম জনের হাত চেপে ধরলেন ভরা সভার মাঝে। তাঁরাও যে পেয়েছেন দেবীর আদেশ!  প্রায় একই রকম ভাবে এসে দেবী তাদের প্রত্যেককে দিয়েছেন আলাদা আলাদা নির্দেশ। অপর দু’জন খুলে বললেন তাদের স্বপ্নাদেশের কথা। 
সবাই বুঝলেন এও এক মায়ের লীলা। পরস্পরের অপরিচিত তিনজনকে স্বপ্নে আদেশ ও পরে তাদের একই অনুষ্ঠানে একত্রিত করা। তিন ব্যক্তি আলোচনা করে স্থির করলেন মন্দির স্থাপনের বিষয়টি। ১৯৭৪ সালের চরনন্দনবাটি গ্রামে গড়ে উঠলো দক্ষিণেশ্বরের আদলে অপর একটি মন্দির। রানি রাসমণির অপূর্ণ ইচ্ছাকে সন্মান জানাতে মন্দির তৈরি হল দক্ষিণেশ্বরের আদলে। আবহনী পুজো ও বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন তৈলঙ্গস্বামীর প্রশিষ্য। প্রায় সাত ফুট লম্বা সে ব্রাহ্মণের বয়স সে সময় শতবর্ষ পেরিয়েছে। যে ঘাটের নাম রানির নাম অনুসারে রানি রাসমণি ঘাট ও সে ঘাটের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হলো রানির অপূর্ণ ইচ্ছার মন্দির। বর্তমানে  জগন্মাতা রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম সংঘ মন্দিরের নিত্য সেবা ও উন্নতির কাজ করে চলেছে। 
এই মন্দিরের সেবাইত স্বামী বামদেবানন্দজীর মুখে শোনা কাহিনির ঐতিহাসিক সত্যতা বিচার করার উপায় বা ক্ষমতা নেই।  কিছু সত্যি, কিছু লোকমুখে প্রচলিত, কিছু অলৌকিক-- সব ঘিরেই মন্দির স্থাপনের ইতিহাস যেন মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। 


রানির বহমান জীবনের দৃশ্য


নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সময় চলে গেছে কয়েক শতাব্দী আগের এক বিস্মৃত ইতিহাসের অধ্যায়ে।  শহর থেকে দূরে একটি ছোট গ্রাম, কোনা।  গ্রামের বাসিন্দা পেশায় চাষি, কৈবর্ত আর কিছু বামন, কায়েত।  কোনা গ্রামের চারদিকে রয়েছে হালিশহর নৈহাটি কাঁচরাপাড়া। তখনকার  নাম অবশ্য ছিল আলাদা। কুমারহট্ট, কাঞ্চনপল্লী ইত্যাদি। কৈবর্ত চাষী হরেকৃষ্ণ দাসের বাড়ি এই গ্রামে।  পেশায় চাষ ছাড়াও চমৎকার ঘর ছাইতে পারতেন।  ঘর ছাউনি হিসাবে বেশ নামডাক ছিল। সেই সঙ্গে ছিল বছরভর দারিদ্রতার থাবা।  এক মেয়ে দুই ছেলে। দুই ছেলের পর তৃতীয় সন্তান মেয়ে।  বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও ছিলেন বিধবা দিদি ক্ষেমাংকরী। হরেকৃষ্ণ দাসের মেয়ে রাসমণি, ডাক নাম রানি। দেড় বছর বয়সে রাস পূর্ণিমার ঠিক আগেই নামকরণ হয় কৈবর্ত ঘরের ফুটফুটে মেয়েটির। ঠিক করা হয় নাম হবে রাসমণি।  



কুমারহট্টর পাশেই কাঞ্চনপল্লি। মাঝামাঝি কোণের দিকের গ্রাম বললেই হয়তো নাম হয়েছিল কোনা গ্রাম। সেখানে রানি রাসমণির নামে তাঁর জন্মভূমিতে গঙ্গার ঘাট। আর এই ঘাটেই রয়েছে নানা ঘটনার সমাবেশ। তখন  রাসমণির মা অকালপ্রয়াত। এমনই এক দুপুরে  এই নদীপথেই ত্রিবেণী সঙ্গমে যাচ্ছিলেন জানবাজারের রাজকুমার রাজচন্দ্র।  ত্রিবেণী গঙ্গাস্নানে পুণ্য অর্জন করতে যাওয়ার সময় এই ঘাটে তিনি দেখেছিলেন ১১ বছরের বালিকা রানিকে।  বজরা থেকে রানিকে নদীর তীরে জল ভরতে দেখা হয়তো বিধাতার সাজানো নাটকের অংশ। দেখা হল দুজনের। ঠিক যেমনটা হওয়ার ছিল। তারপর বিয়ে। কলকাতার জানবাজারের রাজা রাজচন্দ্র ছিলেন বিষ্ণু উপাসক। এক সন্ন্যাসীর দেওয়া আধ হাত উঁচু বিষ্ণু মূর্তি জানবাজারে পূজিত হন রঘুবীর হিসেবে।  আবার কী আশ্চর্য,  রানি রাসমণি  ছিলেন পরম বৈষ্ণব।  তাঁর পিতৃগৃহে থাকাকালীন তাঁর মধ্যে কৃষ্ণ প্রেম জেগে উঠেছিল। 



ক্লান্ত রানি রাসমণি। বিষয়-সম্পত্তি, মামলা মোকদ্দমা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে স্বামীহারাও হয়েছেন। ১৮৩৬ সালে মারা গিয়েছেন রাজচন্দ্র। তার পর থেকে জমিদারির হাল শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন।


 
বেঁচে থাকতে রাজচন্দ্রের মনে একটি মাতৃমন্দির গড়ার বাসনা ছিল। তা বাস্তবায়িত করার বাসনা রানির মনে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর রানী আসছেন তার নিজের গ্রাম দেখতে কোনা গ্রামে। বাপের দেশ দেখতে, নিজের জন্মভূমি, জন্মভিটা দেখতে। রাজচন্দ্র যতদিন বেঁচে ছিলেন রাসমণি জন্মভূমিতে যেতে পারেননি। বাবা অসুস্থ তবুও দেখতে যেতে পারেননি কোনা গ্রামে। বিয়ের পর একবার মাত্র আসা তাও বাবার শ্রাদ্ধের সময়। তারপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, জানবাজার থেকে হালিশহরে আসার সুযোগ বা উপায় হয়নি ।  এবার তিনি মুক্ত। ধর্ম কর্ম ছাড়া আর তার কোন দিকে নজর নেই। ১৮৫১ সালে গঙ্গাসাগর থেকে ফিরে উত্তরায়নের সময় ত্রিবেণীতে স্নান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রানি।  সেই সময় একবার ছুঁয়ে যাওয়া তার প্রিয় কোনা গ্রাম।


তিন জামাইকে ডেকে রানি বললেন,  এবার ত্রিবেণী স্নানে যেতে চান। নির্দিষ্ট দিনে রওনা দিলেন। কোনা গ্রামে একদিন থেকে  যাবেন ত্রিবেণী স্নানে। সে বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে প্রতিবারই উত্তরায়নের সময় ত্রিবেণী স্নানে যেতেন তিনি। 



নিজের গ্রাম নিয়ে আবেগের শেষ নেই তাঁর। চারদিকে এত কিছু করলেন কিন্তু একটা বড় আক্ষেপ থেকে গেল তাঁর মনে। এত স্থানে এত কীর্তি করলেন, কিছুই করা হলো ন শুধুমাত্র নিজের গ্রামে। শুধু ৩০ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামে মা রামপ্রিয়ার নামে গঙ্গার ঘাট বাধিয়ে দিয়েছেন। 


স্মৃতির ঘাট ছুঁয়ে


এই নদীপথেই ত্রিবেণী সঙ্গমের চলার সময় দুজনের দেখা। রাজচন্দ্রের বয়স তখন কুড়ি একুশ,  রাসমণির এগারো। বিয়ের আগে এই নদীপথেই দেখা হয়েছিল রাজচন্দ্রের সাথে। এই পথেই রাজচন্দ্র গিয়েছিলেন ত্রিবেণী তীর্থ স্নান করতে। আবার এই পথেই রানি চলেছেন তার পৈতৃক ভিটেয় পা দিতে। 
এই মন্দির, এই গঙ্গার পথে এগিয়ে ত্রিবেণী সঙ্গম, এই স্থান, সেই হারিয়ে যাওয়া কোনা গ্রাম, সব মিলিয়ে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ক্রমশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে চোখের সামনে। 


বাংলার ১২৫৫ সালে কাশী যাওয়ার তোড়জোড় করেন রানি।  ২৫টি বজরা সাজানো হয় কাশী যাত্রার জন্য।  কিন্তু তার আগেই মা অন্নপূর্ণা স্বপ্নে দেখা দিলেন রানিকে। আদেশ দিলেন, শিবশক্তির মন্দির স্থাপন করার। রঘুবীরের উপাসক রানি শাক্ত দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে আশ্চর্য হলেন। ১৮৫৫ সালে স্থাপিত হল দক্ষিণেশ্বরের মন্দির।


লৌকিক অলৌকিক বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব জীবনের প্রবাহমান একের পর এক ঘটনায় ফুটে উঠছে রানির জীবনের বিভিন্ন চিত্র।  রানি রাসমনির জীবনের এক অজানা অধ্যায়, তার পৈতৃক ভিটের অজানা কিছু কাহিনি যার বেশিরভাগটাই শোনা। 


উৎসব ও ছুটির দিনে ঘোরা


মন্দিরের সামনেই রয়েছে বিশাল মাঠ। মাঠে সারা বছর ধরে চলে নানা অনুষ্ঠান। মন্দিরেও মায়ের নিত্য পূজার সঙ্গে সারা বছর ধরে লেগে রয়েছে নানা উৎসব।  কল্পতরু উৎসব, রটন্তী-ফলহারিণী কালীপুজো, সরস্বতী পুজো, দুর্গোৎসব, রথযাত্রা থেকে শুরু করে কালীপুজো, দোল উৎসব-- এমনই  নানা তিথিতে বছরভর লেগে থাকে নানা উৎসব। মন্দিরে নিত্যভোগেরও আয়োজন করা আছে। দুপুরের ভোগ সেবা করতে পারেন আগত দর্শনার্থীরা। মাতৃ মন্দিরের চত্বরে মন্দিরের পরিবেশটিও অসাধারণ সুন্দর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা।  ঘন্টাপিছু ভাড়া। দরদাম করে নদীর বুকে কয়েক ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া করে এক চক্কর ঘুরে আসা যায়। 


গঙ্গার তীরে গাছপালা ঘেরা শান্ত ছায়ায় বসে দুদন্ড বিশ্রাম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরিমিত অবসর।  নদীর ধারে রয়েছে নানা রকম চাট ও ফুচকার দোকান সঙ্গে অবশ্যই চা কফি বিস্কুট। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি।
আশপাশ এলাকার তো বটেই, দূর দূরান্ত থেকেও মানুষজন আসেন এই গঙ্গার নিরিবিলি সৌন্দর্যটুকু আস্বাদ করার জন্য।  ফুচকা প্রেমীদের জন্য রয়েছে এক বিপুল আয়োজন। রাসমণি ঘাট সংলগ্ন এলাকাটি অন্য আরেক দিকে পরিচিত ফুচকা গ্রাম হিসাবে। বিভিন্ন ধরনের ফুচকা এখানে বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। বিকেলে ছেলেমেয়েদের ফুচকা খাওয়ার উদ্দেশ্যে গন্তব্যস্থল  রাসমণি ঘাট।



মন্দিরের পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে গঙ্গা।  কালের স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে রানি রাসমনির যুগ। হারিয়ে গেছেন সেদিনের নদীর তীরে খেলা করা মেয়েটি। যাকে নদী পথে যেতে যেতে নজরে পড়ে ভালো লেগে গিয়েছিল জানবাজারের রাজার চোখে। তারপর তাঁকে বধূ করে  জানবাজার রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে রানির অতুল কীর্তি। সে সব ইতিহাস এখানকার পথে ঘাটে মাটির ধুলোয় মিশে মিলে একাকার হয়ে রয়েছে। এখানে পা দিলে মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। ঐতিহাসিক রানি রাসমনির কোনা গ্রামের অস্তিত্ব এখন আলাদা করে বোঝানো কঠিন হলেও ঘাটে যাওয়ার আগে বাগের মোড়ে রয়েছে রানির পূর্ণাবয়ব মূর্তি। সেখান থেকেই হয়তো শুরু রানির বাপের বাড়ির কোনা গ্রাম। ইতিহাসের গ্রামের অস্তিত্ব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে নগরায়নের থাবায়। শহরের যান্ত্রিক কোলাহলের মধ্যে নীরবতা ও প্রকৃতির ছোঁয়ায় মনটা তাজা হয়ে ওঠে ইতিহাস ও প্রকৃতির মিলনভূমিতে। 



পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এখনও ততটা প্রচারে আসেনি রানি রাসমণি ঘাট।  কিন্তু লোকমুখে ছড়িয়ে গেছে এখানকার শান্ত কোলাহলমুক্ত পরিবেশের কথা। শীতের ছুটির দিনে প্রকাণ্ড প্রান্তর জমে ওঠে পিকনিকের আমোদে। বছরভর মন্দিরকে কেন্দ্র করে চলা উৎসবে উপস্থিত হন অগণিত ভক্ত দর্শকেরা। রানির মনের মত এমন প্রকাণ্ড দরাজ প্রকৃতি না হলে ইতিহাসের কথা যে মিথ্যা হয়ে যায়। 


কীভাবে যাবেন 


এক বেলার জন্য পিকনিক বা ঘুরে আসার আদর্শ জায়গা হতে পারে রানি রাসমণি ঘাট।  নিজস্ব গাড়িতে যাতায়াতে সহজ কল্যাণী-ব্যারাকপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কল্যাণী মোড়ের থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাগের মোড় হয়ে রাসমণি ঘাট । শিয়ালদা থেকে মেন লাইনে ট্রেন ধরে কাঁচরাপাড়া স্টেশনে নেমে অটো, টোটো বা বাস ধরে বাগের মোড়। সেখান থেকে টোটো ধরে  রাসমণি ঘাট। অথবা কল্যাণী-ব্যারাকপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কল্যাণী মোড় সেখান থেকে বাগের মোড়।  ব্যারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়ার ৮৫ নম্বর রুটে বাস ধরে বাগের মোড় নেমে টোটো। পৌঁছে দেবে রানি রাসমণি ঘাট। আগের দিন ফোন করে বলে রাখলে এখানে কুপন কেটে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সরাসরি যোগাযোগ করে নেওয়া যেতে পারে এই নম্বর গুলিতে।  জগন্মাতা রামকৃষ্ণ-সেবাশ্রম সংঘ, চরচন্দনবাটি-মাঝেরচর ৮৬৭৫১২৯৭৯, ৯৮৩৬২৮০১৬২, ৯৯৬৩১৯৯৬৯৬


 


তথ্যসূত্র :


১. রানি রাসমণি জীবনচরিত - প্রদ্যোৎ গুপ্ত
২. রাজেশ্বরী রাসমণি- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
৩. রানি রাসমণির প্রথম জীবনী - হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. রানি রাসমণি - প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা
৫. জানবাজারের রানিমা - অমরেন্দ্রকুমার ঘোষ
৬. করুণাময়ী রানি রাসমণি - মহামায়া দেবী


 


ছবি- লেখক