সোমনাথ মিত্র, শ্রীরামপুর : চির ছুটিতে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মন খারাপ সিঙ্গুরের রাজনীতিকদের। জমি আন্দোলনের আগুন ঝরানো দিনগুলোয় শিবির করে, চাষের খেত পাহারা দিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও INTUC-র রাজ্য সভাপতি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। জীবনদীপ নিভে যেতেই দীর্ঘ হচ্ছে স্মৃতির শিখা। 


সাতের দশকের ছাত্র আন্দোলনের দামাল নেতা। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে লাঠি হাতে নেমেছিলেন চাষের খেত পাহারা দিতে ! পরনে ট্রেডমার্ক ধুতি-পাঞ্জাবি আর হাতে বাঁশের লাঠি ! সিঙ্গুরের বহু ফসলি জমিতে দাঁড়িয়ে ধানের শিষ ছুঁয়ে দেখছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়! জমি আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি সিঙ্গুরের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে এখন বেরিয়ে আসছে এমনই সব বিরল ছবি। 


তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের একটা সিদ্ধান্তে শান্ত সিঙ্গুর হঠাৎই বদলে যায় আন্দোলনের অগ্নিভূমিতে। বহুফসলি জমিতে টাটাদের একলাখি গাড়ির কারখানা তৈরির সিদ্ধান্ত। তার জন্য ব্রিটিশ আমলে তৈরি জমি অধিগ্রহণ আইন প্রয়োগ। অনিচ্ছুক কৃষক পরিবারের সদস্যদের পিঠে পুলিশের লাঠির বাড়ি... সিঙ্গুরের মাটি তখন গরম ! গায়ের জোরে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। অনিচ্ছুকদের পাশে দাঁড়িয়ে এই দাবিতে জোরদার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন তৃণমূল ছেড়ে সবে কংগ্রেসে ফিরেছেন। সামলাচ্ছেন INTUC-র রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব। সিঙ্গুরে কংগ্রেসের জমি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন তিনি। বাজেমেলিয়ার উজ্জ্বল সংঘ ও গোপালনগরের ঘোষপাড়ায় দুটি শিবির করে জমিতে রাতপাহারার ব্যবস্থা করা হয়। পুরোভাগে সুব্রত মুখোপাধায়। পালা করে দুটি শিবিরে কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে রাত জাগতেন তিনি। বাজেমেলিয়ার এই জমিতেই শিবির করে থাকতেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। 


সিঙ্গুরের কংগ্রেস নেতা বুবাই ঘোষ বলেন, ফোন করে জানালেন সিঙ্গুরের জমি রক্ষা করতে হবে। উর্বর জমি শিল্পপতিদের দেওয়া যাবে না। তাই জমি পাহারা দেবেন। দুটো ক্যাম্পেই পালা করে করে তাঁরা থাকতেন। ক্যাম্পে থাকতে থাকতে অন্য রকম সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে চিনেছিলাম। জমি রক্ষার লড়াইয়ে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তাতে সিঙ্গুরবাসী কৃতজ্ঞ।


পোস্ত, পুঁটি মাছের ঝাল আর দিনে অসংখ্যবার চিনি ছাড়া লিকার। এই সব খেতেই পছন্দ করতেন নিপাট বাঙালি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এখনই সেই স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছে সিঙ্গুর কংগ্রেস। এমন এক জমি যোদ্ধার প্রয়াণে শোকাহত জমি আন্দোলনের আরেক সৈনিক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে মন খারাপ সিঙ্গুরের মাস্টার মশাই ও প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়কের। বলেন, তিনি জমিতে নেমে কৃষকদের শিক্ষা দিয়েছিলেন কীভাবে আন্দোলন করতে হয়। সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। পরে মন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল।


২০০৮ সাল । কংগ্রেসে থেকেও, সিঙ্গুরে মমতার ধর্নামঞ্চে যোগ দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রাজনীতির সব মহলে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। সিঙ্গুর আন্দোলনের আরেক নেতা বেচারাম মান্নার সঙ্গেও তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। প্রায় প্রতি বছরই যেতেন শ্রমমন্ত্রীর ক্লাবের জগদ্ধাত্রী পুজোয়। শ্রমমন্ত্রী ও বিধায়ক বেচারাম মান্না বলেন, তাঁর মৃত্যু মানতে কষ্ট হচ্ছে। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।