শুভেন্দু ভট্টাচার্য, কোচবিহার: ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল (Chitmahal) বিনিময় হয়েছিল। নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছিল দুই দেশের প্রায় ৩৭ হাজার মানুষ।বৃহস্পতিবার সেখানে পালিত হল স্বাধীনতা দিবস (Independence day)।


ছিট মহল কীভাবে তৈরি হল তার অনেক গল্প আছে। কেউ কেউ বলেন,কোচবিহারের মহারাজা ও রংপুরের মহারাজার মধ্যে পাশা খেলার হারজিতের ফলে এই ছিটমহলগুলি তৈরি হয়েছিল। কোচবিহারের মহারাজা যখন জিততেন সেই সময় উপহার হিসেবে তিনি রংপুরের রাজ্যের কিছু জমির অংশ পেতেন। অন্যদিকে রংপুরের মহারাজা জিতলে তিনিও কোচবিহার রাজ্যের ভেতরে কিছু জমির অংশ উপহার হিসেবে পেতেন। এইভাবে ১৬২ ভূখণ্ড তৈরি হয় যার মধ্যে রংপুরের ভেতরে কোচবিহারের মহারাজার ১১১টি ভূখণ্ড আর কোচবিহার রাজ্যের ভেতরে রংপুরের মহারাজার জয় করা ৫১টি ভূখণ্ড। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল তবে দেশভাগের পর সমস্যা তৈরি হল। সীমান্তের নকশা তৈরির সময় বাকি থেকে যায় এই ভূখণ্ডগুলি। আর তার ফলেই একসময় পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এই ছিটমহলগুলি। পরে স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করার পরেও একইভাবে থেকে যায় এই ছোট ছোট ভূ-ভাগগুলি। তবে প্রথমদিকে সেই ভাবে সমস্যা হতো না, অনায়াসেই দূরদেশের মধ্যে মানুষ যাতায়াত করতে পারতেন। কিন্তু, পরবর্তীকালে কাঁটাতারের বেড়া বসার ফলে বন্ধ হয়ে যায় দু'দেশের ছিটমহলের মানুষের মধ্যে যাতায়াত। একদিকে যেমন ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ৫১টি ভারতীয় ছিটমহল তেমনিভাবে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতের ভেতরে থাকা ১১১টি বাংলাদেশি ছিটমহল। 


এই ছিটমহলের সমস্যা সমাধান নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী, মুজিবর রহমান,নরসিমা রাও, খালেদা জিয়া, মনমোহন সিংহ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একাধিক চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে অধরা রয়ে গেছে ছিটমহল বাসীদের স্বাধীনতা। একের পর এক লড়াই আন্দোলন করতে হয়েছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের। একসময় ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক দীপক সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। পরে তাঁর ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যান এবং সফলতা লাভ করেন। অবশেষে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলি বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। 


এ তো গেল ছিটমহল বিনিময়ের ইতিহাস। কিন্তু, কেমন ছিল তাঁদের দিনগুলি তা এখনও ভাবলে চোখে জল চলে আসে ছিট মহলের বাসিন্দাদের। না ছিল তাঁদের কোনও দেশের পরিচয়পত্র। বাবার নাম গোপন করে পড়তে হত বিভিন্ন স্কুলগুলিতে। পরিচয়হীন, স্বাধীনতাহীন হাজার হাজার মানুষ। জমি বিনিময়ের পাশাপাশি সেখানকার বসবাসকারী মানুষদের অপশন দেওয়া হয় তাঁরা কোন দেশে থাকতে চান। সেক্ষেত্রে ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলের একজনও বাংলাদেশ যাননি। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের ৯২০ জন ভারতে চলে আসেন। তাঁদের অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয় দিনহাটা মেখলিগঞ্জ ও হলদিবাড়ির তিনটি শিবিরে। এখন তাঁদের স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 


দীর্ঘ ৯ বছর পর কেমন আছে ছিটমহলের বাসিন্দারা? গত ৯ বছরে পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই, হয়েছে রাস্তাঘাট, ভোট দিতে পেরেছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে, এছাড়া আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে তাঁদের জীবনে। 


এখন আর তাঁদের পরিচয় গোপন করে পড়াশোনা করতে হয় না। চাষাবাদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান তাঁরা। লুকিয়ে লুকিয়ে আর দিন কাটতে হয় না এই মানুষগুলোকে। তবে সমস্যা আছে বেশ কিছু। এখনও তাঁদের জমির কাগজের সমস্যাগুলো মেটেনি। এছাড়াও যাঁরা বাংলাদেশ থেকে দেশে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে পুনর্বাসন প্যাকেজের আশা নিয়ে এদেশে পৌঁছেছিলেন নিরাশ হয়েছেন। সব মিলিয়ে গত ৯  বছরে অনেক কিছুই পাননি এমনটাই অভিযোগ। তবে সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়েছে স্বাধীনতা পেয়েছেন, পেয়েছেন পরিচিতি। বৃহস্পতিবার তাই বিভিন্ন সাবেক ছিট মহলগুলিতে মর্যাদার সঙ্গে তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হল। তোলা হল ভারতের জাতীয় পতাকা।


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।


আরও পড়ুন: Rachana Banerjee: বই হাতে পড়া ধরলেন ছাত্রদের, 'দিদিমণির' ভূমিকায় হুগলির স্কুলে সাংসদ