কলকাতা: রাজ্য সরকারের দুই পোর্টালে মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকার অভিযোগ। যে পোর্টালে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ বাধ্যতামূলক, সেখানে মৃতের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ। অন্য দিকে, যে পোর্টালে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ না করলেও চলে, সেখানে মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। মৃত্যু সংক্রান্ত সরকারি তথ্যের এই ফারাক সামনে আসতেই একটি পোর্টাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের স্বাস্থ্যভবন। (Swasthya Bhawan)
রাজ্যএ গত তিন বছরে কত সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই অসঙ্গতি ধরা পড়ল। জন্ম-মৃত্যু তথ্যের পোর্টাল অনুযায়ী, গতবছর মৃত্যু হয়েছে ৬ লক্ষ ৬২ হাজার ৯৯১ জনের। 'মেডিক্যাল সার্টিফিকেশন অফ কজ অফ ডেথ পোর্টালে ২০২৩ সালে রাজ্যে মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ৩৯৫ জন। রাজ্য সরকারের দু'টি পোর্টালের তথ্যে মৃতের সংখ্যার ফারাক ৫ লক্ষ ২৭ হাজার ৫৯৬। ২০২২ এবং ২০২১ সালেও মৃত্যু সংক্রান্ত সরকারি তথ্যে এই অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। (West Bengal Death Records)
রাজ্যের কোনও নাগরিক মারা গেলে, তাঁর মৃত্যুর শংসাপত্র জারির আগে, তাঁর নাম রাজ্যের পোর্টালে তুলতে হয়। এমন দু'টি পোর্টাল রয়েছে রাজ্য, একটি হল, MCCD পোর্টাল অর্থাৎ মেডিক্যাল সার্টিফিকেশন কজ অফ ডেথ। কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, তার উল্লেখ করতে হয়। ওই MCCD পোর্টালে দেখা গিয়েছে, ২০২৩ সালে রাজ্যে মারা গিয়েছেন ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের কিছু বেশি মানুষ।
২০১৯ সালে যে 'জন্ম-মৃত্যু তথ্য' পোর্টাল চালু করে, সেই JMT-তে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে রাজ্যে মারা গিয়েছেন ৬ লক্ষ ৬২ হাজারের বেশি মানুষ। অর্থাৎ দুই পোর্টালে মৃতের পরিসংখ্যানে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই নয়, ২০২২ সালেও একই রকম ফারাক চোখে পড়ে। একটি পোর্টালে ১ লক্ষের কিছু মানুষ মারা গিয়েছেন বলে দেখানো হয়, অন্যটিতে মৃতের সংখ্যা দেখানো হয় সংখ্যাটা প্রায় ৬ লক্ষ। আবার ২০২১ সালে একটি পোর্টালে ১ লক্ষ ২২ মৃত বলা হয়, অন্যটিতে ৫ লক্ষ ১৫ হাজার মৃত্যু দেখানো হয়। এই ফারাক সামনে আসতেই একটি পোর্টাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য়ভবন।
কেন এই ফারাক? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্ম-মৃত্যুর তথ্য যেখানে থাকে, সেই পোর্টালের অ্যাকসেস শুধুমাত্র স্বাস্থ্যভবন, চিকিৎসক বা মেজিক্যাল কলেজ ও সরকারি হাসপাতালের হাতে নেই। রাজ্যের পঞ্চায়েত, পুরসভা, শ্মশান, সমাধিস্থল কর্তৃপক্ষের হাতেও। মৃত্যুর কারণ উল্লেখ না করে সেখান থেকেই মৃতের সংখ্যা যোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, "শ্মশান, কবরস্থান, পুরসভা, পঞ্চায়েত সবার হাতে অ্যাকসেস রয়েছে। এই ফারাক থাকবেই। কারণ বেশির ভাগ মানুষ বাড়িতে মারা যান। চিকিৎসক ডেথ সার্টিফিকেট দিলে কারা আপলোড করেন সেটা দেখতে হবে।" তিনি জানান, এই অসঙ্গতির প্রভাব পড়তে পারে জনস্বাস্থ্যের উপর। কারণ মৃত্যুর কারণ জানা না গেলে, কোন রোগ বেড়ে গিয়েছে, মানুষের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রোগ বেড়েছে, তা বোঝা যাবে না। কোভিড হলে লিখতে হবে, কম বয়সিরা যে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, স্ট্রোক হচ্ছে, ডায়বিটিস, কিডনির রোগ হচ্ছে অল্পবয়সিদের। এতে খাওয়াদাওয়ায় কোথায় গন্ডগোল হচ্ছে বুঝতে হবে।
চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, "কোভিডের সময়, ডেঙ্গির সময়ও তথ্য গোপন হয়েছে। আমরা চেঁচামেচি করতাম। কোনও না কোনও ভাবে, এই সরকারের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, তথ্য গোপন রেখে রাজ্য ভাল আছে বলে প্রমাণের তাগিদ জারি থেকেছে। রোগ তো সরকার নিজে তো আনে না? তাহলে তথ্যগোপন কেন। এতে মানুষের ক্ষতিই হয়। জন্ম-মৃত্যুর তথ্যের কথা বলতে গেলে, শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রকেও জানাতে হবে। এতটা ফারাক হয়ে গেলে চিন্তার।"
MCCD পোর্টালে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। বহু দিন ধরেই এই রীতি চালু। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই মৃত্যুর সঠিক কারণ না উল্লেখ করে সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। MCCD পোর্টালের সঙ্গে JMT পোর্টালের সংখ্যায় এই ফারাক নিয়ে টনক নড়েছে। রাজ্য জানিয়েছে, MCCD পোর্টালটি আর রাখা হবে না। একটাই পোর্টাল থাকবে, JMT. কিন্তু এতদিন সেখানে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ না করতে হলেও, এবার থেকে পঞ্চায়েত, পুরসভা, শ্মশান, কবরস্থান কর্তৃপক্ষ, সকলকে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করতে হবে।