রাজা চট্টোপাধ্যায়, জলপাইগুড়ি: পুরভোটের আগে জলপাইগুড়িতে প্রকাশ্যে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দল। নতুন পার্টি অফিস উদ্বোধনের আগেই ঘরোয়া বিবাদে সুর কাটল জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির।
আগামী ২৮ অক্টোবর শহরের ডিবিসি রোডে বিজেপির নব নির্মিত পার্টি অফিসের উদ্বোধন করতে আসছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং সর্বভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দলের তরফে তার প্রস্তুতি তুঙ্গে।
তার ঠিক চার দিন আগেই রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিলেন ভারতীয় জনতা কিষাণ মোর্চার প্রাক্তন জেলা সভাপতি নব্যেন্দু সরকার এবং এবারের বিজেপির বিধানসভার প্রার্থী তথা বর্তমান বিজেপির জলপাইগুড়ি টাউন মণ্ডলের পর্যবেক্ষক সৌজিত সিংহ।
একজন তো বলেই দিলেন, বেনোজলেদের দল থেকে না সরালে পুরসভা নির্বাচনে তিনটি ওয়ার্ডও দখল করতে পারবে না বিজেপি। আরেকজনের অভিযোগ, ভোটের আগে রাতের অন্ধকারে টাকার বিনিময়ে দলকে বিক্রি করে দিয়েছিল জেলার একাংশ। তাই বিধানসভা ভোটে হার হয়েছে।
ভারতীয় জনতা কৃষাণ মোর্চার প্রাক্তন জেলা সভাপতি নব্যেন্দু সরকার বলেন, বিধানসভা ভোটের আগে কেন্দ্র ও রাজ্য নেতৃত্ব বাইরে থেকে নেতাদের এনে বড় বড় ভাষণ দিয়েছিল যে, এবার ক্ষমতায় আসবেই। এখানে নিচুতলা ও তৃণমূল স্তরের কর্মীরা সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ অন্য দল থেকে আসা বেনোজলকে বিধানসভার টিকিট দেওয়া হল।
তিনি বলেন, দলে অনেক ভালো নেতা কর্মীরা ছিলেন, যাঁরা বিধানসভার প্রার্থী হতে পারতেন। অথচ, তাঁদের করা হয়নি। ফলে, সামান্য ভোটে হেরে গেল। এর জন্য দায়ী একমাত্র রাজ্য ও জেলা নেতৃত্ব। তাই, কর্মীদের মনোবল ভেঙে গিয়েছে। কেউ দলীয় দফতরে যান না। ৬০ শতাংশ কর্মী ঘরে বসে গিয়েছেন। জেলা নেতৃত্ব কারোর খোঁজ নেয় না।
নব্যেন্দু সরকারের দাবি, আগামী ২৮ তারিখের অনুষ্ঠানের জন্য কেউ আমন্ত্রণ পাঠায়নি বা কোনও নেতার ফোনও পাননি। বললেন, এর কারণ বেনোজলদের কাছে খরচের হিসেব চাইব। বিধানসভা ভোটের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সেটা নিচুস্তরের প্রত্যেক কর্মীর কানে পৌঁছে গিয়েছে। আগে প্রতিবাদ করেছিলাম তাই দূরে সরিয়ে রেখেছে।
তাঁর মতে, পুরসভার ভোটের আগে তাঁবেদারি করা বেনোজলদের দল থেকে বার না করলে তিনটি ওয়ার্ডও ক্রস্ করতে পারবে না বিজেপি। তিনি বলেন, পুর-নির্বাচনে দল স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি নিচু স্তরের কর্মীদের প্রার্থী করলে তাহলেই দলের পাশে থাকব।
নব্যেন্দু সরকার বলেন, যদি আবার বেনোজলদের প্রার্থী করে তাহলে দলের বিরুদ্ধে সরব হব। কাটোয়ার মতো ক্ষোভ-বিক্ষোভ হবে। আর তার জন্য দল দায়ী থাকবে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি ও বর্তমান রাজ্য সভাপতি। যদিও
তিনি জানিয়ে দেন, ২৮ তারিখ রাজ্য নেতৃত্ব এলে প্রতিবাদ প্রদর্শনের ইচ্ছে তাঁর নেই। তবে সুকান্ত মজুমদারের কাছে অনুরোধ থাকবে তাঁর শিক্ষাটা যেন দলের স্বার্থে কাজে লাগান তিনি। তবে, সেদিন বাইরের কর্মীরা যদি কোনও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তার জন্য আমরা দায়ী থাকব না।
বিধানসভার প্রার্থী তথা বর্তমান টাউন মন্ডলের অবজার্ভার সৌজিত সিংহ বলেন, সংগঠনে যাঁরা ছিলেন তাঁরা অধিকাংশই থেকে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন পার্টির সঙ্গে যে যোগাযোগ ছিল বিধানসভা ভোটের পর থেকে তা যে কিছুটা ব্যাহত হয়েছে সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
তিনি বলেন, বিধানসভার ফলাফলের নিরিখে ১৬ থেকে ১৭ টি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়েছিল। সেটাকে ধরে রাখতে হলে আমাদের মানুষের পাশে থাকতে হবে। যতটা করার প্রয়োজন ছিল বিগত দিনে সেটা আমরা করতে পারিনি বিভিন্ন কারণে। তবে এখনও সময় রয়েছে।
তিনি যোগ করেন, সংগঠনকে দাঁড় করাতে জেলা নেতৃত্বকে দেখতে হবে কেন দলীয় কর্মীরা আসছেন না। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার আছে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ যা আছে সেটা শোনা দরকার। তাঁদের আশ্বাস দিতে হবে আগামীতে এরকম হবে না। তবে দলের অনুশাসন না থাকলে তাঁদের ধরে রাখা মুশকিল।
২৮ তারিখের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের হাজার হাজার কর্মী আছে। সবাইকে আলাদা ভাবে ফোন করে ডেকে আনা সম্ভব নয়। বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে। তবে এঁরা দলের সঙ্গেই আছেন। সরজমিনে আসছেন না কিছু কারণ থাকতে পারে।
তাঁর উষ্মা, কর্মীরা এত খাটাখাটির করেছেন দলকে জেতাতে। তারপর দেখা গেল একটা অংশ রাতের অন্ধকারে দলকে বেচে দিয়েছে। তাই তাঁরা এখন বলছে কেন যাব? এই জায়গাতেই ক্ষোভ। রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বকেই আশ্বস্ত করতে হবে আগামীতে এইসব হবে না।
এপ্রসঙ্গে বেজেপির জেলার সহ সভাপতি অলোক চক্রবর্তীর পাল্টা দাবি, অনেক নেতারাই বলছে এরকম ঘটেছে। তবে কোনও তথ্য প্রমাণ নেই। এসব কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে বলেছে। তাঁর মতে, কর্মী সমর্থকরা প্রত্যেকে এখন বিজেপিকে চাইছেন।
তিনি বলেন, যাঁরা রাতের অন্ধকারে তৃণমূলের সঙ্গে মিশেছে, যাঁরা রাতের অন্ধকারে নিজেরা সওদা করেছ তাঁরাই একমাত্র এসব কথা বলছে। তাঁদেরকে আমরা জেলা নেতৃত্ব বলে মনে করি না। তাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিজেপি পার্টিকে ব্যবহার করেছেন। ফলে তাঁরা কি বললেন বা বললেন না তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনা। আগামী দিনের লড়াইয়ে সবাই আমাদের সঙ্গে আছে।
বিজেপির এই গোষ্ঠীকোন্দলকে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। শাসক দলের নেতা তথা পুরসভার প্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য সন্দীপ মাহাত বলেন, বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি অনেক চমক দেখিয়েছিল। বাংলার মানুষ কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায়কেই চায়। সব প্রকল্প মানুষ গ্রহণ করেছে। আগামী পুরনির্বাচনেও সরকারের প্রতি ভরসা রাখবে এবং ক্ষমতায় আনবে মানুষ। বিজেপিকে বলব, আগে তাদের ঘর সামাল দিক তারপর পুরসভা দখলের কথা স্বপ্ন দেখুক। রাজ্য নেতৃত্বর সামনেই হাতাহাতি হচ্ছে তাই আগে ঘর গোছান তারপর তৃণমূলের কথা চিন্তা করবেন।