প্রসূন চক্রবর্তী, বাঁকুড়া :  বাঁকুড়ার ঘোষ বাড়ির পুজো ( Bankura Ghosh Bari Puja )। মা নিজেই বলেছিলেন তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে। পুজোর যাবতীয় আয়োজন করেওছিলেন নিজে। এখন তেমনটাই করে থাকেন। ঘোষ বাড়ি থেকে পুরোহিত, কারিগর, ঢাকি , কাউকেই ডাকা হয় বা। কী অদ্ভূত না ! তাহলে পুজোটা হয় কী করে? পড়ুন সেই গল্প, যেখানে মিলেমিশে গিয়েছে ইতিহাস ও জনশ্রুতি। 


শুরুর কথা
সালটা ছিল ১৬৮০ থেকে ১৭০০। দেশে তখন চলছে বর্গী আক্রমণ। হুগলির সেনাই অঞ্চলে বসবাস করত ঘোষ পরিবার। বর্গীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছেড়ে প্রাণ ভয়ে তাঁরা আশ্রয় নেন বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়ের থানার খোসালপুর গ্রামে। তাদের পাশেই ছিল বেনে সম্প্রদায়ের বসবাস। তাঁরা জঙ্গলের মধ্যেই কালী মায়ের পুজো করতেন। কিন্তু তাদেরই মধ্যে কিছু দুষ্ট লোক মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছিলেন। তাতে দেবী অত্যন্ত রুষ্ট হন।


জনশ্রুতি, এরপর দেবী এক কিশোরকে স্বপ্নাদেশে মন্দিরে ডেকে আনেন।  দেবীর আদেশে ওই কিশোর নিজের শিরোচ্ছেদ করেন মায়ের সামনে। তাতে ভয় পেয়ে বেনে সম্প্রদায়ের মানুষজন  এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে পুজো।


মায়ের আগমন
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে যায়। ঘোষ পরিবারের এক গৃহবধূ স্থানীয় কালীবাঁধে পুকুরের ঘাটে প্রতিদিন যেতেন। সেখানে তিনি জলের উপরে কালী মায়ের দুটি হাত দেখতে পেতেন। এরপর দেবী ঘোষ পরিবারের ওই গৃহবধূকে স্বপ্নাদেশে অভয় বাণী দেন যে তিনি নরবলি পেয়ে শান্ত হয়েছেন। তিনি  কারও উপর রুষ্ট হবেন না। তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে আদেশ দেন।


ওই গৃহবধূ মাকে বলেন, তাঁরা তো গরিব, কীভাবে মায়ের পুজো করবে ? উত্তরে মা জানান পুজোর সমস্ত কিছু আয়োজন তিনি নিজেই করবেন। তারপর নির্জন জায়গা থেকে সরিয়ে এনে ঘোষ বাড়ি সংলগ্ন কালিবাঁধ পুকুরের সামনে মন্দির স্থাপন করে দেবীকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুজোর মূর্তি গড়ার কারিগর থেকে শুরু করে পুরোহিত, ঢাকি, ঝুমুর, কাঁসর, বাজনদারকে এক কন্যা রূপে মা স্বয়ং তাদের বাড়ি গিয়ে মণ্ডপে আশার আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এখানে জনশ্রুতি আর কিংবদন্তি মিলেমিশে একাকার। 


পুজোর দিন সকলেই ঘোষ পরিবারে এসে উপস্থিত, বিষয়টি কেউ বুঝতে পাচ্ছিলেন না। এদিকে তাঁরা এসে বলছিলেন, আপনাদের পরিবারের এক কন্যা আমাদের নেমন্তন্ন করে এসেছে। তখন ঘোষ পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারলেন এ কাজ মায়ের। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ঘোষ পরিবারের কালী পুজোতে কাউকে নেমন্তন্ন করা হয় না। পুজোর মূর্তি গড়ার কারিগর থেকে শুরু করে পুরোহিত, ঢাকি, ঝুমুর, কাঁসর, বাজনদার প্রত্যেকেই বংশ পরম্পরায় প্রতিবছর তাঁরা পুজোয় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন।


ঐতিহ্য মেনে পুজোর দুদিন আগে থেকেই নহবতের আসর বসে। গ্রামে দুর্গাপুজো হয় না বলে কালীপুজোকে কেন্দ্র করে বাসিন্দারা এই কয়দিন ধরে মেতে ওঠেন। আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও পুজো দেখতে আসেন। পুজোয় জীব বলি বন্ধ হলেও বর্তমানে পাঁঠা, চালকুমড়া ও আখ বলি হয়। পুজো উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পুজোর দুদিন আগে থেকে ঘোষবাড়ির বৈঠকখানায় সকাল ও সন্ধ্যা দু’বেলা নহবত বসে। শিল্পীরা দুন্দুভি ও সানাইয়ের সুরে মণ্ডপ মাতিয়ে রাখেন।