কলকাতা: একদিকে অবিরাম বয়ে চলেছে গঙ্গা। তার পাড়েই রয়েছেন দুর্গেশ্বর মোটা মহাদেবের (Mota Mahadev) বাসস্থল। প্রায় ৩৫০ বছরেরও বেশি সময়ের স্মৃতি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির (Mahadev Temple) । উত্তর কলকাতার নিমতলা শ্মশানকে পেছনে রেখে কিছুদূর হেঁটে গেলেই দর্শন মিলবে। গায়ে বট অশ্বত্থের ঝুরি নিয়ে দন্ডায়মাণ এই প্রাচীন মন্দির। দেখে যেন মনে হয় কত ইতিহাস বুকে নিয়ে, কত কালের কত না বলা গল্প বলতে চায় মন্দিরের প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথর। মাথা তুলে যতদূর চোখ যায় শুধুই বট অশ্বত্থের শিকড় নেমে এসেছে, দেখতে অনেকটা শিবের (Lord Shiva) জটার মতোই। আটচালা এই মন্দিরেই রয়েছে বিশাল শিবলিঙ্গ। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় জমান এই বিগ্রহ দর্শনে।
লোকমুখে প্রচারিত গল্প: মন্দির নিয়ে লোকমুখে প্রচারিত একাধিক গল্প। কেউ বলেন, 'একদিন নাকি গর্ভগৃহের দরজা খুলে দেখা যায় শিবলিঙ্গ নেই। পরে গঙ্গা থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁকে। সেই থেকেই নাকি মহাদেবকে এখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে তিনি স্থান ছেড়ে পালিয়ে না যেতে পারেন'। তবে এসব গল্পের কোনও সত্যতা নেই বলেই দাবি করেছেন পুরোহিতরা। তাঁরা বলছেন, সবটাই মানুষের মুখে মুখে তৈরি গল্প। যদিও মন্দিরে একটি কোণায় দুটি বড় শিকল রাখা হয়েছে প্রায় ৩০০ বছর ধরে। কিন্তু তা কেন রাখা সে কথাও কারও জানা নেই।
প্রতিষ্ঠা বৃত্তান্ত: ১৭১৬ সালে হাটখোলার (Hatkhola) দত্ত পরিবারের মদনমোহন দত্তের দুই পুত্র রসিকলাল দত্ত এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সম্প্রতি কলকাতা হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এই দুর্গেশ্বর মোটা মহাদেবের মন্দিরটি। ভাস্কর্যের নির্মাতা শিল্পী গদাধর দাস। বর্তমানে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন দীপক পুলোভী এবং গৌড়চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
মন্দির ভাঙতে নিষেধ: এখন প্রশ্ন জাগতে পারে এমন জাগ্রত মন্দির কেন ভগ্নপ্রায় দুর্দশায় দাঁড়িয়ে? রক্ষণাবেক্ষণ? মন্দিরের সেবায়ত পুরোহিত দীপক পুলোভী বলেন 'বহুবার মন্দির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, পুজোআচ্চাও করা হয়েছিল মন্দির সংস্কারের উদ্দেশে। তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই মন্দিরের গায়ে হাত দেওয়া যায়নি। বহু প্রমোটার কাজ করতে এসেও ফিরে গিয়েছেন'। এই মন্দিরের গায়ে হাত দিতে গেলেই নাকি কোনও না কোনও সমস্যা তৈরি হয়েছে প্রত্যেকবারই। তাই এইভাবেই রয়েছে মন্দিরটি। 'হয়ত বাবা এভাবেই থাকতে চান'। বলছেন সেবায়ত পুরোহিত দীপক পুলোভী।
পূজার্চনার নির্ঘণ্ট: প্রতিদিন ভোর ৫টায় খুলে যায় মন্দিরের দ্বার। শুরু হয় মঙ্গলারতি। আরতির শেষে গর্ভগৃহে প্রবেশ করে শিবলিঙ্গে জল ঢালার অনুমতি রয়েছে। প্রকাণ্ড আয়তনের এই শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালতে হয় লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে। ১২ টায় শুরু হয় ভোগ আরতি। এর পর আর কাউকে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ভোগের পর কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে মন্দির। ফের বিকেল ৪ টের সময়ে খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। তবে এই সময়ের পর থেকে আর কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয় না গর্ভগৃহে। বাইরে থেকে পুজো দেওয়া যায়। রাত্রি সাড়ে আটটায় হয় সন্ধ্যা আরতি। এরপর প্রার্থনার শেষে শয়নে যান মহাদেব। বন্ধ হয় মন্দিরের দরজা।
শ্রাবণের উৎসব: গোটা শ্রাবণজুড়ে উৎসবের আমেজ এই মন্দিরে। গুরুপূর্ণিমা (Guru Purnima) থেকে শুরু করে রাখীপূর্ণিমা (Rakhi Purnima ) পর্যন্ত সময়টা জাঁকজমক চলতে থাকে রোজই। পুরষোত্তম এই মাসের প্রতি সন্ধ্যায় রাজবেশে সাজেন মোটা মাহাদেব। ফুলের পোশাক, গহনায় সে এক অপরূপ দৃশ্য।
হাজারও বিশ্বাস নিয়ে ফি বছর এখানে ভিড় জমান বহু দর্শনার্থী দূর-দূরান্ত থেকে আসেন মানুষ। তাঁদের বিশ্বাস ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ করেন মোটা মহাদেব। সেবায়তরাও এমনটাই বলছেন। সব মিলিয়ে শ্মশান চত্বরে নানান গল্পগাথা নিয়ে বিরাজমান দুর্গেশ্বর মোটা মহাদেব। মানুষের বিশ্বাস অঞ্চলের সকলের রক্ষাকর্তা তিনিই।
আরও পড়ুন: Shiva: দেশের এই জ্যোতির্লিঙ্গে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব একসঙ্গে পূজিত হয়, এই মন্দিরে তাই ছুটে আসেন ভক্তরা