কলকাতা: ক্রিজে দাঁড়িয়ে একসময় দাপটের সঙ্গে ব্যাটিং করেছেন দু'জনেই। কিন্তু এখন দু'জনেই কার্যত রিজার্ভ বেঞ্চে। মাঝে রাস্তা আলাদা হয়ে গিয়েছিল বটে। এখন আবার এক ছাতার নিচেই কার্যত। তাতেই দীর্ঘ দিন পর ফের জমাটি আড্ডা। শারদসন্ধেয় মুখোমুখি  বসলেন শোভন চট্টোপাধ্যায় (Sovan Chatterjee) এবং মদন মিত্র (Madan Mitra)। তাতে যোগ দিলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও (Baishakhi Banerjee)। আর তাতেই উঠে এল ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আক্ষেপের কথা। 


ষষ্ঠীর সন্ধেয় শোভান-বৈশাখীর বাড়িতে হাজির মদন


ষষ্ঠীর সন্ধেয় আচমকাই শোভন-বৈশাখীর গোলপার্কের ফ্ল্যাটে পৌঁছন মদন। কলিং বেলের বোতাম টিপতেই হাসিমুখে দরজা খুললেন স্বয়ং বৈশাখী। আসি আসি করে আগে বহু বার এসে পৌঁছননি মদন। তাই দোরগোড়ায় মদনকে দেখেই বাঁধ ভাঙল উচ্ছ্বাস। অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে সতীর্থকে স্বাগত জানালেন শোভনও। তার পর জমাটি আড্ডা ত্রয়ীর, সঙ্গী এবিপি আনন্দের প্রতিনিধি। বলা বাহুল্য, কোনও রকম রাখঢাক ছাড়াই নিজেদের আবেব-অনুভূতি তুলে ধরলেন তাঁরা। 


একসময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন দু'জনে। সক্রিয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে নেই বললেই চলে শোভন। আর মদন থেকেও কার্যত নেই। তাই স্মৃতিচারণায় ডুব দিলেন দু'জনে। অতীত মনে করে গেয়ে উঠলেন, "পুরানো সেই দিনের কথা..."। গানের সুরেই হয়ত বা মদনের মনের অবস্থা টের পেলেন শোভন। তাই গানেই জবাব দিলেন, "কোই জব তুমহারা হৃদয় তোড় দে, তড়পতা হুয়া জব সব হি ছোড় দে, তুম মেরে পাস আনা প্রিয়ে, মেরা দর খুলা হ্যায়, খুলা হি রহেগা তুমহারে লিয়ে।"


ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের জেরে তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শোভন। পরে যোগদান করেন বিজেপি-তে। কিন্তু সেখানে তাঁর ইনিংস ছিল স্বল্পমেয়াদি। তাই একসঙ্গে যেমন গিয়েছিলেন, তেমনই একসঙ্গেই বিজেপি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শোভন-বৈশাখী। তার পর নবান্নের চোদ্দতলায় সোজা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপণ্ণ হন। তার পর থেকে তৃণমূলে তাঁদের প্রত্যাবর্তনের খবরে দিন কয়েক বাজার গমগম করলেও, আনুষ্ঠানিক ভাবে জোড়াফুল পতাকা তাঁদের হাতে উঠতে দেখা যায়নি এখনও। আবার একসময় তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা থাকলেও, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় 'রঙিন' ভাবমূর্তি নিয়েই চলছে মদনের। দলে যে আগের মতো গুরুত্ব নেই, ঠারেঠোরে তা একাধিক বার বুঝিয়েও দিয়েছেন তিনি। তাই পুরনো সতীর্থকে পাশে পেয়ে কিছুটা আবেগতাড়িতই হয়ে পড়লেন।



আরও পড়ুন: Durga Pujo: আজ সপ্তমী, গঙ্গার ঘাটে নবপত্রিকা স্নানের পর দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা


আর তা টের পেয়েই বোধহয় বৈশাখী জানিয়ে দিলেন, শোভন এবং মদন, দু'জনের হৃদয়ে আজও মায়ের স্থানে একজনই বিরাজ করেন, তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, "তোমরা দু'জনে জননী হিসেবে যাঁকে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে যাঁকে বসিয়ে রেখেছো, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আবেগ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার মনে হয়, তৃণমূল যত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যাক না কেন, কিছু প্রাপ্তির জন্য যাঁরা দলে থাকেন, তোমরা তাঁদের মধ্যে পড়ো না। তোমাদের ভিতরের এই প্রশান্তিটাই দলের আসল শক্তি।"


শোভন এবং মদন, দু'জনকেই তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। একদিকে নারদকাণ্ডে যেমন নাম উঠেছে শোভনের, তেমনই বৈশাখীর সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে মমতার বিরাগভাজন হতে হয় তাঁকে। আবার সারদা, নারদ কাণ্ড পেরিয়ে বিধায়ক হিসেবে টিকে থাকলেও, মমতার বিশ্বস্তদের মধ্যে থাকা মদন ক্রমশই তৃণমূলের পিছনের সারিতে গিয়ে পৌঁছেছেন। তাই ইদানীং কালে শিক্ষক নিয়োগ কাণ্ডে যখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম উঠে আশে, কোনও রাখঢাক করতে দেখা যায়নি তাঁকে। শোভনের গলাতেও সেই সুরই ধরা পড়ল। তাঁর কথায়, "আজকে যা ঘটছে, রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার জন্য তাঁরা নিজেরাই দায়ী। আমি ৪০ বছর, মদনদা ৫০ বছর রাজনীতি করছি। আমরা রাজনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ৩৪ বছরের বাম শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইটা ভুয়ো প্রতিশ্রুতি ছিল না। মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের নিরাপত্তা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা।"


রাজনীতি থেকে ব্যক্তিগত জীবন, আলোচনায় উঠে এল সবকিছুই


তাহলে কি এখন রাজীনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে তাঁদের! তাই কি নবান্নে গিয়ে মমতার সঙ্গে সাক্ষা করলেও, তৃণমূলে ফেরা নিয়ে এখওনও কিছু পাকা হয়নি শোভনের! মদনও কি তাই ময়দান ছাড়ার কথা বলছেন! শোভনের দাবি, তাঁরা রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েননি, রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যেই তৈরি হয়েছে বিতৃষ্ণা। কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে এতদিনের যে লড়াই, এত যে প্রতিশ্রুতি, তা কি এত সহজেই ছেড়ে দিতে পারবেন! এ বারও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য মদনের। তাঁর কথায়, "খাদের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সরে না গেলে, পড়ে যাব।"