করুণাময় সিংহ, মালদা: ডিজিটাল যুগে আরও সহজলভ্য হয়ে উঠেছে খবর। কিন্তু সেখানে জায়গা পাওয়াও এখন বেশ দুষ্কর। পাতা জুড়ে থাকে ধনকুবেরের অট্টালিকা, তারকাদের হাঁড়ির খবর।  তার মধ্যেও মাঝেসাঝে হাতে উঠে আসে কিছু মণিমুক্তো, যেখানে মেহনতি মানুষের লড়াই জায়গা করে নেয় কোনও এক কোণে। মালদার কেশব দাস সেই তালিকায় উজ্জ্বলতম সংযোজন, যিনি ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেননি শুধু, সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার কৃতিত্বও অর্জন করেছেন (WBCS Exams)। আর সেই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন গোটা পরিবারকে (Underdog)।


ঘটিবাটি বিক্রি করে ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলার গল্প আজকাল তেমন নাড়া দেয় না আমাদের। কিন্তু বেকারত্বের জ্বালা যখন ক্রমশ গিলে খাচ্ছে, সেই সময় কেশবরা উদাহরণ তৈরি করেন। কারণ শুধু আর্থিক নয়, মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক বাবা, কানের দুল বিক্রি করে ছেলেকে পড়ানো মা, দিন আনি দিন খাই পরিবারকে ভাল রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছেন। তাই নিজের এলাকায় তো বটেই, গোটা বাংলায় মুখে মুখে ফিরছে তাঁর।


বেকারত্বের জ্বালা যখন ক্রমশ গিলে খাচ্ছে, সেই সময় কেশবরা উদাহরণ তৈরি করেন


মালদা (Malda News) জেলার হরিশচন্দ্রপুরের ২ নম্বর ব্লকের দৌলতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত হরদমনগরের ছেলে কেশব। বয়স এখনও ৩০ ছোঁয়নি, ২৮। ইচ্ছেশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের জোরে WBCS পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার অর্থাৎ BDO হিসেবে শীঘ্রই দায়িত্ব পেতে চলেছেন হাতে। তাঁর এই সাফল্যের কাহিনিই এখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে।  বিষয়টি জানাজানি হতেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা সে ভিড় করছেন। মিষ্টির প্য়াকেট, ফুলের তোড়া হাতে ধরিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন সকলে।


কিন্তু এই সাফল্য পেতে কত লড়াই করতে হয়েছে, তা জানেন শুধু কেশব এবং তাঁর পরিবার। কেশবের বাবা জ্ঞানবান দাস পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক। লকডাউনের সময় থেকে বাড়িতে বসে রয়েছেন। দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন কখনও। কখনও আবার জমিতে কাজ করেন। তাতে যে টাকা আয় হয়, সংসার চালানো যায় না। কিন্তু ছেলেকে মানুষ করে তুলবেনই, জেদ ছিল অসীম। তার জন্য ব্য়াঙ্ক থেকে ঋণও নিয়েছেন, যা মেটাতে পারেননি আজও। বিক্রি করে দিতে হয়েছে গয়নার নামে স্ত্রীর কানে থাকা ফিনফিনে সোনার দুল পর্যন্ত। কিন্তু জ্ঞানবান এবং গোটা পরিবারের ত্যাগের মর্যাদা রেখেছেন ছেলে কেশব। 


আরও পড়ুন: Asha Workers Agitation : আশা কর্মীদের স্বাস্থ্য ভবন অভিযান ঘিরে তুলকালাম, পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে অসুস্থ বেশ কয়েকজন


২০২২ সালে হরদমনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন কেশব. ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ৭৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে। এ পর মালদা কলেজে সংস্কৃত অনার্স নিয় ভর্তি হন। ২০১৮ সালে হগৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর মালদায় হস্টেলে থেকে নিজেকে গড়ে তুলতে উদ্যত হন কেশব। টাকার অভাবে কোচিং নিতে পারেননি। টিউশন পড়িয়ে কোনও রকমে নিজের খরচ চালাচ্ছিলেন। ২০২০ সালে দ্বিতীয় বার WBCS পরীক্ষায় বসেন। এ বছর ২ ফেব্রয়ারি তার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে WBCS একজিকিউটিভ ‘A’ বিভাগে বাংলা ২৭তম স্থান অধিকার করেছেন।


কঠিন পরিশ্রম WBCS-এ কেশবকে সাফল্য এনে দিয়েছে


ছোট থেকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল কেশবের। কঠিন পরিশ্রম WBCS-এ তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছে। জ্ঞানবান জানিয়েছেন, তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। কেশব সবার থেকে ছোট। ছোট থেকেই পরিশ্রমী ছিলেন, মেধাবীও। পড়াশোনার জন্য কখনও বকাঝকা করতে হয়নি কেশবকে। মাধ্যমিক পাস করে সাইকেলের আবদাপ করেছিলেন কেশব। কিন্তু তা-ও কিনে দিতে পারেননি। বরং প্রতিদিন ছয় কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন কেশব। WBCS-এর প্রস্তুতির জন্য ল্যাপটপ কেনার ইচ্ছা ছিল কেশবের। হয়ে ওঠেনি তা-ও। সেই সব ছাড়াই নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন কেশব। তাই জ্ঞানবানের উক্তি, “সব ঘরে যেমন এমন ছেলে জন্মায়।” কেশবের সাফল্যে খুশি হরিশচন্দ্রপুরের সব মানুষও। দলে দলে গিয়ে সকলে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন কেশব ও তাঁর পরিবারকে।