কলকাতা: ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে ফের কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই, কেন্দ্রীয় সরকার ওই সংশোধনী বিল এনেছে বলে মন্তব্য করলেন তিনি। এভাবে চললে, ওই সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হলে, ওয়াকফ ব্যবস্থাই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। (Mamata Banerjee)


বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে সরব হন মমতা। স্পষ্ট জানালেন, নিয়ম অনুযায়ী, নতুন কোনও বিল আনতে গেলে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা করেনি। বরং সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তির আকারে সেটি বের করা হয়। খোঁজ খবর নিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায়। এর পর সংসদে তাঁদের সাংসদরা প্রতিবাদ জানান। এর পর যৌথ সংসদীয় কমিটি তৈরি করতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। (The Waqf (Amendment) Bill 2024)


শুধু তাই নয়, চাপে পড়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি তৈরি করা হলেও, সেখানে বিরোধীদের কথা বলার কোনও সুযোগ নেই বলেও অভিযোগ করেন মমতা। এদিন বিধানসভায় একটি বিশদ রিপোর্টও পেশ করেন মমতা। কেন্দ্রের সংশোধনী বিলে কোথায় কোথায়, কী কী নিয়ে আপত্তি রয়েছে, তা উল্লেখ করে রাজ্যের তরফে কেন্দ্রকে চিঠি দেওয়া হয় বলে রিপোর্ট তুলে ধরেন। 


মমতা সাফ জানিয়েছেন, এই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ওয়াকফ সম্পত্তি দখল হয়েছে বলে আগেও অভিযোগ এসেছে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ওয়াকফ  সম্পত্তি দখল হয়েছে বলে নজির নেই পশ্চিমবঙ্গে। এর সপক্ষে একটি তালিকাও পেশ করেন মমতা, যাতে কোন কোন জায়গায় নতুন করে ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে, তার বিশদ তথ্য ছিল।


একই সঙ্গে এদিন মমতা জানান, বহুকাল আগে যে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল হয়েছে, তা উদ্ধার করেত বুলডোজার নামানো যাবে না। মমতা যুক্তি দেন,  এখন যাঁরা ওই জায়গায় রয়েছেন, সেখানে বসবাস করছেন, কিছু গড়ে তুলছেন, সেগুলি ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেওয়ার নীতি নেই রাজ্যের। ওই সমস্ত মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকার বুলডোজার নীতি গ্রহণ করবে না। বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়া যেতে পারে। তাঁর সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বেড়ে ৪৭২ থেকে ৪৩৮১ কোটি হয়েছে বলে জানান মমতা। সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার টাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দিলেও, তাঁর সরকার চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান।


ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অতীশীও সেই নিয়ে চিঠি দেন, যাতে তিনি অভিযোগ করেন, দিল্লি সরকারের অনুমতি ছাড়াই রিপোর্ট জমা দিয়েছেন ওয়াকফ বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক অশ্বিনী কুমার। এমনকি এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে সংসদীয় বৈঠকে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা অধুনা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঝামেলা বাধে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বোতল ছুড়তে গিয়ে কল্যাণের হাতও কেটে যায়। (Winter Session of Parliament)


ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলে বলা হয়েছে, ১) কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ ঘোষণার অধিকার আর ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকবে না, বরং জেলাশাসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। ২) ওয়াকফ বোর্ডে দুই মহিলা সদস্যের পাশাপাশি, দুই অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাখাও বাধ্যতামূলক। ৩)  মুসলিম এবং অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর ধরে যাঁরা ইসলাম ধর্ম পালন করে আসছেন, একমাত্র তাঁরাই ওয়াকফ বোর্ডকে সম্পত্তি দান করতে পারবেন। ৪) হিন্দু মন্দিরের মতো ওয়াকফ বোর্ডও ধর্মনিরপেক্ষ বিধিবদ্ধ সংস্থা বলে গন্য হবে। এর আগে লোকসভায় সংশোধনী বিলটি পেশ করা হলে, বিরোধীরা আপত্তি জানান। শেষ পর্যন্ত একমত হতে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হয়। কিন্তু একতরফা ভাবে, অন্যায় ভাবে কমিটির চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের।


কেন্দ্রের প্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে বিরোধীদের দাবি, আসলে ওয়াকফ বোর্ডের গুরুত্ব খর্ব করাই এই বিলের লক্ষ্য। ওয়াকফ বোর্ডে মহিলাদের উপস্থিতির প্রস্তাবকে যদিও স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অন্য ধর্মীয় সংস্থাগুলির বোর্ডে ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধিদের স্থান নেই যেখানে, সেখানে ওয়াকফ বোর্ডের জন্য ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে কেন? অতি সম্প্রতি যদি কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে কেন সম্পত্তি দান করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন, এই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। অন্য ধর্মের বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে দাবি তাঁদের। ওয়াকফ বোর্ডকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' হতে হবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হলেও, পুরীর মন্দিরে কেন অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। মুসলিমদের হাতে থাকা জমি কেড়ে নিতেই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও। যদিও সম্প্রতি নির্বাচনী গুরুগ্রামে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ জানান, শীতকালীন অধিবেশনে ওয়াকফ (সংশোধী) বিল নিয়ে জটিলতার অবসান ঘটবে।