সমীরণ পাল, সুজিত মণ্ডল ও প্রকাশ সিন্হা, কলকাতা : কামদুনি থেকে হাঁসখালি, বিচার এখনও মেলেনি। কামদুনির ঘটনার পর ১২ বছর কেটে গেলেও, এখনও মূল অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে ৪ জনই বেকসুর খালাস হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টে এখনও মামলা চলছে। তেমনি হাঁসখালিকাণ্ডের সাড়ে ৩ বছর হয়ে গেলেও এখনও ফাইনাল চার্জশিটই দিতে পারেনি সিবিআই।

Continues below advertisement

দুর্গাপুরকাণ্ডে দ্রুত সুবিচার চাইছেন নির্যাতিতা ডাক্তারি পড়ুয়ার বাবা। চাইছেন দোষীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হোক। দুর্গাপুরের ঘটনা যেমন মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আর জি কর ধর্ষণ-খুন কাণ্ডকে, তেমনই কামদুনি গণধর্ষণ ও নদিয়ার হাসখাঁলি ধর্ষণকাণ্ডের বীভৎসার কথা।

উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনি থেকে নদিয়ার হাঁসখালি, অতীতে আলোড়ন ফেলে দেওয়া মামলাগুলোর আজ কী অবস্থা ? কামদুনিকাণ্ডে আন্দোলনকারী শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, "অভয়ার বাবা-মা যা বলেছেন, কামদুনিও তাই বলছে, কোনও বিচার এখানে পাওয়া যাবে না।"

Continues below advertisement

২০১৩ সালের ৭ জুন। কামদুনির ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা রাজ্য়কে। পাঁচিল ঘেরা ফাঁকা জমি থেকে উদ্ধার হয় এক কলেজ ছাত্রীর মৃতদেহ ! গণধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল তাঁকে। ভয়ঙ্কর সেই ঘটনার দশদিন পর, ২০১৩-র ১৭ জুন কামদুনিতে গিয়ে দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, "১৫ দিনের মধ্য়ে চার্জশিট দিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের চিফ সেক্রেটারি, ডিজি, আপনাদের আগেই বলেছেন, যে এই দুটো কেসের জন্য় আমরা দরকার হলে ফাঁসি এবং মৃত্য়ুদণ্ড দুটোই আমরা চাইব। কোর্টের কাছে চাইবে গভর্নমেন্ট।"

ঘটনার তদন্তভার যায় CID-র হাতে। পরবর্তীকালে ব্য়াঙ্কশাল আদালত ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায়। ২০২৩-এর ৬ অক্টোবর কামদুনিকাণ্ডে ৩ দোষী সাব্যস্তের ফাঁসির সাজা রদ করে কলকাতা হাইকোর্ট। ২ দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় ও ৪ জনকে খালাস করে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গেছে নিহত কলেজ ছাত্রীর পরিবার।

কামদুনিতে নিহত কলেজছাত্রীর ভাই বলেন, "আমাদের কামদুনির কেস খুবই খারাপ অবস্থায় এখন। এই নিয়ে ৫টা কেস উঠে গেল, এদিকে রাজ্য সরকারের কপিল সিব্বল দাঁড়াচ্ছেন...উপস্থিতই নেই। আমাদের উকিল উপস্থিত আছেন। রাজ্য সরকারের উকিল উপস্থিত নেই। তার কারণেই কেসটা বারবার স্টে হয়ে যাচ্ছে। যে দু'জন আছে, সেই দুজন কেউ এই রাজ্য সরকার বের করে দেবে।"   

একসময় যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরাই এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ! কামদুনিকাণ্ডে প্রতিবাদী মৌসুমী কয়াল বলেন, "রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সিআইডির টিমও আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিল। বলেছিল, আমরা পাশে আছি। কিন্তু, যে নথিগুলোর প্রয়োজন, সেগুলো এখনও পর্যন্ত সিআইডি জমা দেয়নি। আমরা তো বিচার পেলাম না। আমাদের সামনে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনও আমরা ভয় পাই, তাদের দেখলে। এই সেই আসামি যারা ধর্ষণ করেছিল, আজ ঘুরে বেড়াচ্ছে।" 

পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিচার তো হয়েছে। কোর্ট তো বলেছে।" 

২০২২-এর চৌঠা এপ্রিল নদিয়ার হাঁসখালির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায় রাজ্যে। জন্মদিনের পার্টির নাম করে নাবালিকাকে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরের দিন মৃত্যু হয় নাবালিকার। তারপর তড়িঘড়ি দেহ সৎকার করানোর অভিযোগও ওঠে। এই ঘটনা প্রসঙ্গে মুখ্য়মন্ত্রী বক্তব্য় ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। তিনি বলেছিলেন, "ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির নাকি লভ অ্যাফেয়ার ছিল... বাড়ির লোকেরাও সেটা জানত... পাড়ার লোকেরাও জানত। এখন যদি কোনও ছেলেমেয়ে প্রেম করে, সেটা আমার পক্ষে আটকানো সম্ভব নয়।"

হাসখালির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য় সমরেন্দ্র গয়ালির ছেলে ব্রজ গয়ালির নাম উঠে আসে। সেই ঘটনায় পরে তদন্তভার যায় CBI-এর কাছে। মূল অভিযুক্ত ও তার বাবা তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য-সহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। মূল অভিযুক্ত, তার বাবা-সহ ৪ জন জেলে থাকলেও, ৫ অভিযুক্ত জামিন পেয়ে গেছে। কিন্তু তারপর সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। এখনও সেই ঘটনায় চূড়ান্ত চার্জশিট দিতে পারেনি CBI। নিহত নাবালিকার মা বলেন, "কোনও বিচার এখনও আমি পাইনি। সবার আমি শাস্তি চাই। মা হিসাবে বলছি, এরকম যেন আর কোনও জায়গায় মায়ের কোল খালি করে না। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া দরকার।"

এ প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার বক্তব্য, "বহু ক্ষেত্রে এরাজ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সি কাজ করতে পারে না, এই রাজ্য সরকারের সর্বক্ষেত্রে অসহযোগিতার জন্য। যে কারণে তদন্ত বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে কারণে ঠিকভাবে সমস্ত বিচার-প্রক্রিয়াও চলতে পারে না। এই বিচ্যুতির জন্য অনেক ক্ষেত্রে আসামি ছাড়া পেয়ে যায়।" 

পুলিশ হোক কিংবা সিবিআই, তদন্ত যেই করুক, এখনও সুবিচারের অপেক্ষায় কামদুনি থেকে হাসখালি!