রায়গঞ্জ: দুদিকে বিস্তৃত রাজমহল পাহাড়। মাঝখান দিয়ে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে কুলিক নদী। প্রকৃতি যেন ঢেলে সাজিয়েছে বাংলার এই জেলাকে। উত্তর দিনাজপুর। পাহাড়-জঙ্গলের মিশেলে পর্যটকদের জন্য অদম্য আকর্ষণ। সারা বছর ধরেই যে জেলায় ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়। আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির মণিমুক্তো। পরতে পরতে জড়িয়ে ইতিহাস। বেড়াতে ভালবাসলে, আপনার ক্যালেন্ডারের কয়েকটা দিন উত্তর দিনাজপুরের জন্য বরাদ্দ রাখতেই হবে।


জেলার সদর রায়গঞ্জ। উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যকেন্দ্র এই শহর। কুলিক নদীর তীরে সুন্দর ছিমছাম শহর। এখানেই রয়েছে রায়গঞ্জ বণ্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র (Raiganj Wildlife Sanctuary)। যা এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয়। জাতীয় সড়ক, রাজ্য সড়ক ও রেলপথ, গোটা রাজ্যের সঙ্গে উত্তর দিনাজপুরের সুন্দর যোগাযোগের মাধ্যম। জেলার প্রাণকেন্দ্র ছুঁয়ে গিয়েছে এনএইচ ৩১ ও এনএইচ ৩৪। রয়েছে দুটি মহকুমা। রায়গঞ্জ ও ইসলামপুর। ১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল তদানিন্তন দিনাজপুর জেলা ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের জন্ম।


জেলার দর্শনীয় স্থান


রায়গঞ্জ বণ্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র


অনেকে বলেন, কুলিক পাখিরালয়। পাখি প্রেমিকদের স্বর্গ। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয়। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১৬৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে এই অভয়ারণ্যে। প্রত্যেক বছর সত্তর থেকে আশি হাজার পরিযায়ী পাখি আসে এখানে। ইংরেজি বর্ণমালার 'ইউ' অক্ষরের আদলে এই অভয়ারণ্য। কুলিক নদীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। চিল, প্যাঁচা, কাঠঠোকরা থেকে শুরু করে মাছরাঙা, দোয়েল, শ্যামা, বুলবুলি, কোয়েল, দোয়েল, চড়ুই, বৌ কথা কও, বসন্তবৌরি, হাঁড়িচাচা, কোকিল, ইষ্টিকুটুম, বক, সারস, কী নেই এখানে। সঙ্গে প্রত্যেক শীতে ভিনদেশি পাখির ভিড়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি পাখির দেখা মেলে। পক্ষীপ্রেমিকদের জন্য আদর্শ সময়।


কুনোর গ্রাম


কুনোর উত্তর দিনাজপুরের একটি ছোট গ্রাম। পোড়ামাটি ও মাটির কাজের জন্য বিখ্যাত। অনেক মৃৎশিল্পী এবং কারিগর অভিনব মূর্তি ও সামগ্রী তৈরি করেন। মোটিফ তৈরি করা এখানকার কারিগরদের আরেকটি সুন্দর প্রবণতা। মোটিফের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় তাল গাছ, গণেশের মূর্তি, শিশু-সহ উপজাতীয় মহিলা এবং অন্যান্য সাধারণ মোটিফ। কুনোর গ্রামের কারিগররা বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পী। পোড়ামাটির ঘোড়া বলতে অনেকে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃৎশিল্প বোঝেন। তবে কুনোর হাটপাড়া গ্রামের পোড়ামাটির ঘোড়াও বিখ্যাত। বিশ্বব্যাপী রপ্তানি করা হয় এখানকার টেরাকোটার কাজ। পাশাপাশি মাটির ল্যাম্পশেড, ফুলদানি, ঝাড়বাতি এবং প্রদীপ সমান সুন্দর ও আকর্ষনীয়।


বুরহানা ফকির মসজিদ


বুরহানা ফকির মসজিদ উত্তর দিনাজপুরের সংস্কৃতি ও ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান। মসজিদটি স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। মসজিদের নকশা এবং সামনে সম্প্রসারিত সবুজ লন বেশিরভাগ মানুষকে আকৃষ্ট করে। মনোমুগ্ধকর মুঘল স্থাপত্য, গম্বুজ ও দেওয়ালে শিল্পের অগণিত রূপ চিত্তাকর্ষক। মসজিদের ভেতরটাও সুসজ্জিত।


রায়গঞ্জ চার্চ


রায়গঞ্জ চার্চ শহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির মধ্যে একটি। গির্জাটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু দেখে মনে হয় এটি বেশ প্রাচীন। এই কাঠামোর নকশা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। গ্রিক স্তম্ভগুলি চার্চের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম। ষড়ভুজ গম্বুজ এবং গির্জার দেওয়ালে খোদাইকৃত শিল্পকর্ম স্থানমাহাত্ম্য আরও বাড়িয়ে তোলে। একসঙ্গে ২০ হাজার মানুষ গির্জায় প্রবেশ করতে পারেন।


কর্ণজোড়া মিউজিয়াম


কর্ণজোড়া মিউজিয়াম এবং পার্ক উত্তর দিনাজপুরের একটি প্রধান আকর্ষণ। এটি পোড়ামাটির ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত। জাদুঘর এবং পার্ক সবুজ বাগিচা দিয়ে ঘেরা। কর্ণজোড়ার টেরাকোটার কাজ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ চিত্তাকর্ষক।


শ্রী দিগম্বড় আদিনাথ জৈন মন্দির


উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে অবস্থিত শ্রী দিগম্বর আদিনাথ জৈন মন্দির উত্তর দিনাজপুরের অন্যতম বিখ্যাত ধর্মীয় স্থান। এই জৈন মন্দিরের ৩১ ফুট লম্বা আদিনাথ মূর্তি হল এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বিখ্যাত জৈন সাধক গণিনী প্রমুখ আরিকা এবং দেশভূষণজি মহারাজ এই মন্দিরটি নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


সাপ নিকলা জঙ্গল


চোপড়া ব্লকে অবস্থিত সাপ নিকলা জঙ্গল প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্যতম সেরা আকর্ষণ। ইসলামপুর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সবুজের ভিড়ে সময় কেটে যায় হু হু করে।


ভোপালপুর মেলা


জুন মাসে এনএইচ ৩৪ লাগোয়া স্বামীনাথ মন্দির সংলগ্ন হাসুয়া গ্রামের ভোপালপুরে মেলা বসে। বাঁশের ওপর নানারকম হস্তশিল্প, মুখোশ, কুলো, ডোকরার কাজ বিক্রি হয়। সারা বছর পর্যটকেরা ভিড় জমান। এখানকার ডোকরার কাজের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। ডালখোলার ব্রোঞ্জের কাজও বিখ্যাত।


সংস্কৃতি


উত্তর দিনাজপুরের সঙ্গীত হিসাবে খান, নাটুয়া, জং গান জনপ্রিয়। সঙ্গে মোক্ষ ডান্স ও হালনা হালনানি নৃত্যও ভীষণ জনপ্রিয়।


কীভাবে যাবেন



  • আকাশপথে গেলে বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ।

  • সড়কপথে কলকাতা থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। মালদা থেকে দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে ১৮১ কিলোমিটার। রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বাস পরিবহণ ব্যবস্থা।

  • রেলপথে নিকটতম স্টেশন হল বালুরঘাট। সেখান থেকে গাড়ি করে রায়গঞ্জ পৌঁছে যাওয়া যায়।


কোথায় থাকবেন



  • দিনান্তে ট্যুরিজম প্রপার্টি, মাধুপুর, ফোন নম্বর: ৯৭৩৩০০৮৭৯১, ই-মেল: tourismcentrekolkata@gmail.com

  • পথসাথী ইটাহার, ইটাহার, ফোন নম্বর: ৯৬১৪৩৮৯৩৬৭

  • পথসাথী ডালখোলা, ডালখোলা, ফোন নম্বর: ৯৭৭৫৯০২৭৩৮

  • পথসাথী ইসলামপুর, ইসলামপুর, ফোন নম্বর: ৮৯৭২০৬৬৩৮৫