পার্থপ্রতিম ঘোষ, কলকাতা : ডানলপের সুশান্তকুমার হাজরা, লেকটাউনের (Lake Town) নির্মলকুমার বণিক, যাদবপুরের (Jadavpur) কৌশিককুমার দাস বা বেহালার কান্তি চক্রবর্তী। মাথার ওপর শেষ বয়সে একটা পোক্ত ছাদের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারজন্য দিয়েছিলেন সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ। এখন প্রায় সমস্ত সঞ্চয় খুইয়ে উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।


স্বপ্ন ছিল, অবসরের পর শেষ বয়সে, মাথার উপর থাকবে একটা পোক্ত ছাদ ! প্রতিবেশী হবে, অফিসের বন্ধুরাই ! কিন্তু, সেই স্বপ্নপূরণ তো হয়নি ! বরং, এখন স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা ভোগ করছেন ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ব্রাঞ্চে একদা কর্মরত, ৪২৯ জন নাগরিক। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো এই প্রবীণ মানুষগুলোর থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে, ফ্ল্যাট না দিয়ে, ওই টাকায় নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার অভিযোগ উঠেছে বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহানের (Nusrat Jahan) বিরুদ্ধে। আর যাঁদের টাকা গেছে, তাঁরা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন !


যেমন- ডানলপের বাসিন্দা সুশান্ত কুমার হাজরা। ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্কে অ্য়াসিস্টান্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৯-এ অবসর নেন। সারাটা জীবন ছোট্ট ফ্ল্যাটে কেটেছে। ইচ্ছে ছিল বাকি জীবনটা একটু স্বাচ্ছন্দে কাটানোর। স্বপ্নপূরণ তো হয়ইনি। চলে গেছে, পিএফ ও গ্রাচুইটির অনেকটা টাকা ! এখন কীভাবে মেয়ের বিয়ে দেবেন বুঝতেই পারছেন না বছর ৬৪-র সুশান্ত কুমার হাজরা। তিনি বলেন, 'ভাবনা ছিল, অবসরের পরে একটু ভালভাবে থাকব। কিন্তু, সেই সুযোগ পেলাম না। এরকমভাবে ফেঁসে যাব বুঝতে পারিনি। মেয়ের বিয়ে দেওয়া বাকি আছে। এই অবস্থায় আমরা পথে বসেছি। ডিটেলসে জানতাম না। লিডারদের সব যোগাযোগ ছিল। এর মুখে ওঁর মুখে ব্যাপারটা এসেছে।'




অবসরের পর, বড় একটা ফ্ল্যাট, আর সেই সঙ্গে সহকর্মীদেরই সান্নিধ্য। একথা ভেবেই বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বছর ৬৫-এর নির্মল কুমার বণিক। লেকটাউনের বাসিন্দা এই প্রৌঢ় ২০১৭ সালে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পদে অবসর নেন। লোন নিয়েছিলেন। অবসরের পরই পিএফ ও গ্রাচুইটি থেকে সেই টাকা কেটে নেয়। তিনি বলছেন, 'একটু বেশি জায়গায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে, পরিবার নিয়ে থাকব আশা জেগেছে। সেইজন্য ফ্ল্যাটটা কিনলাম। সঞ্চিত যা ছিল তা বিনিয়োগ করেছি। চার বছর সুদ দিয়েছি। যখন শোধ করলাম তখন আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টার্মিনাল বেনিফিট যা পেয়েছি, সব কেটে নিল ব্যাঙ্ক। তার চাপটা তো এখনও আমার উপর পড়ছে। ওই টাকাটা কম হাতে পেয়েছি। জীবনের সঞ্চয় থেকে কিছু চলে গেল !'

ভাল থাকার, ভালভাবে থাকার স্বপ্ন কার না থাকে ? ব্যতিক্রমী নন, যাদবপুরের সন্তোষপুরের বাসিন্দা সত্তর ছুঁইছুঁই কৌশিককুমার দাস। চিফ ম্যানেজার পদে অবসর নেন ২০১৪ সালে। তাঁর দাবি, 'নুসরত জাহানের মতো নাম শুনে ভরসা পেয়েছিলেন। টাকা দিতে দু'বার ভাবেননি। আজ সেই জন্য়ই কপাল চাপড়াচ্ছেন। কৌশিকবাবু বলছেন, বিনিয়োগের আগে যখন মেমোরেন্ডাম অ্যাসেসমেন্ট দেখেছি, তখন কিন্তু নুসরত জাহান নাম ছিল। ভেবেছিলাম, একজন সেলিব্রিটি রয়েছেন যখন, নিশ্চয়ই আমাদের টাকাপয়সা সেফ থাকবে। ভেবেছিলাম ঠিক সময়ে ফ্ল্যাটটা পেয়ে যাব।'

একই পরিস্থিতি, বেহালার বাসিন্দা কান্তি চক্রবর্তীরও। তিনি বলছেন, 'প্রতারিত হব ভেবে কি কেউ টাকা দেয় ! ভেবেছিলাম, একটা সুন্দর ফ্ল্যাট হবে। সেখানে একসঙ্গে সব থাকব।' 

চাকরিজীবন শেষ। সারা জীবনের সঞ্চয় জলে যাওয়ার ধাক্কা সামলাবেন কীকরে? সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না এই বয়স্ক মানুষগুলো।