কলকাতা: সাদা কাপড় সরিয়ে ছেলের দেহ খুঁজছেন বাবা। বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনার পর টিভির পর্দায় এই দৃশ্য নাড়া দিয়েছিল সকলকে। রক্তাক্ত, বিকৃত দেহ দেখে এখনও প্রিয়জনকে চেনার চেষ্টা করছেন বহু মানুষ। সেই আবহেই হৃদয়গ্রাহী মুহূর্তের সাক্ষী হল ওড়িশা। ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃতদেহের স্তূপ জমা থাকতে দেখেও, ছেলে বেঁচে আছেন বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন এক বাবা। চরম হতাশার মধ্যেও আশা ছাড়েননি তিনি। তবে শেষ মেশ আশাহত হতে হল না তাঁকে। মর্গে জমা শতাধিক নিথর দেহের মধ্যেই জীবিত অবস্থায় ছেলের খোঁজ পেলেন তিনি (Odisha Train Accident)।
অভিশপ্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলার নাগরিক। এখনও পর্যন্ত বাংলা থেকে ১০০ জন মারা গিয়েছেন বলে মিলেছে খবর। হাওড়ার ,বাসিন্দা, ২৪ বছরের বিশ্বজিৎ মালিকও করমণ্ডল এক্সপ্রেসে সওয়ার ছিলেন। তাঁকেও মৃতদের মধ্যেই ধরা হচ্ছিল। কিন্তু আশা ছাড়েননি পেশায় দোকানদার তাঁর বাবা হেলারাম মালিক (Howrah News)।
শালিমার স্টেশনে গিয়ে নিজেই করমণ্ডল এক্সপ্রেসে তুলে দিয়ে এসেছিলেন তিনি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর সেই ট্রেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছে শুনে ধাক্কা খেয়েছিল পরিবার। নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছিল। ছেলের খোঁজ পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল ওই পরিবার। লাগাতার ছেলেকে ফোন করে যাচ্ছিলেন হেলারাম। এভাবে সব শেষ হয়ে যেতে পারে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাঁর।
শেষ পর্যন্ত আশাহত হতে হল না হেলারামকে। পর পর বেশ কয়েক বার ফোন বেজে গেলেও, একটা সময় ফোনের ওপার থেকে ছেলের গলা শুনতে পান হেলারাম। দুর্বল কণ্ঠে বিশ্বজিৎ বাবাকে জানান, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তাঁর। কিন্তু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। নড়ার শক্তি নেই। তার পর আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি হেলারাম।
পলাশ পণ্ডিত নামের স্থানীয় এক অ্যাম্বুল্যান্স চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হেলারাম। তাতে চেপে শুক্রবার রাতেই রওনা দেন ওড়িশার উদ্দেশে। এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে ২৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ওড়িশার বালেশ্বর পৌঁছন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েই ছেলের হদিশ পাননি। বরং চরম হয়রানির শিকার হতে হয় তাঁকে।
কোথায় রয়েছেন, কী অবস্থায় রয়েছেন, বাবাকে ফোনে তা জানাতে পারেননি বিশ্বজিৎ। তাই বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিতে শুরু করেন হেলারাম। কিন্তু কোথাও ছেলের খোঁজ পাননি। তাতেও আশা ছাড়েননি বিশ্বজিৎ। স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করেন। তাতে জানতে পারেন, বাহানাগা স্কুলে অস্থায়ী মর্গ গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে প্রচুর দেহ রাখা আছে। মন শক্ত রেখে সেখানেি পৌঁছন তিনি।
সারিবদ্ধ ভাবে রাখা মৃতদেহের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পেতে হিমশিম খান হেলারাম। কিন্তু তখনই সাড়া পড়ে যায় মর্গে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা একটি শরীর, যাকে সকলে নিষ্প্রাণ বলে ধরে নিয়েছিলেন, আচমকাই তার ডানহাতটি কেঁপে উঠতে দেখেন সকলে। তাতে ছুটোছুটি শুরু হয়। শেষ মেশ দেখা যায়, ওই হাত বিশ্বজিতেরই। গুরুতর আঘাত পান তিনি। যন্ত্রণা কাবু করে ফেলেছিল তাঁকে। তাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এর পর আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি হেলারাম। ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলেন। বালেশ্বরের হাসপাতালে নিয়ে ছোটেন। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা বিশ্বজিৎকে ভর্তি নিতে চাননি। কটক মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাতেও ভেঙে পড়েননি হেলারাম। বন্ডে সই করে ছেলেকে নিয়ে সোজা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন। শেষ পর্যন্ত SSKM হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তি করেন তিনি। অবস্থা সঙ্কটজনক হলেও স্থিতিশীল রয়েছেন বিশ্বজিৎ। গোড়ালিতে অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। মঙ্গলবার আরও একটি অস্ত্রোপচার রয়েছে।
হেলারাম সংবাদমাধ্যমে বলেন, "হাল ছাড়িনি আমি। ছেলে নেই, মানতে পারিনি। কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করছিলাম। তাতেই ওই স্কুলে পৌঁছই।" ছেলেকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়াই এই মুহূর্তে লক্ষ্য হেলারামের। হাসপাতালেই কার্যত পড়ে রয়েছেন তিনি।