কলকাতা: প্রাথমিকে ৩২ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বহাল রইল। অর্থাৎ ডিভিশন বেঞ্চে চাকরি বাতিলের রায় খারিজ হয়ে গেল কলকাতা হাইকোর্ট। কলকাতা হাইতোর্টের প্রাক্তন বিচারপিত অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ই প্রথম ৩২০০০ চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন। পরিবর্তে তিন মাসের মধ্যে নতুন করে নিয়োগ সম্পূর্ণ করতে নির্দেশ দেন তিনি। আদালত জানিয়েছে, দীর্ঘ ন'বছর চাকরি বাতিল করলে, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও তাঁদের পরিবারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই ৩২ হাজার চাকরি বহাল থাকছে। (Primary Teachers Case)

Continues below advertisement

বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ বুধবার জানায়, সকলের চাকরি বহাল থাকছে। দুর্নীতির মামলার তদন্ত যেমন চলছে। কিন্তু তার প্রভাব যেন চাকরিরতদের উপর না পড়ে। আদালত জানিয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে বলেই সকলের চাকরি বাতিল করা যায় না। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল, ন'বছর চাকরি করার পর যদি কারও চাকরি বাতিল হয়, তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এঁরা সমস্যা পড়বেন, পরিবার সমস্যায় পড়বে। বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে। তাই কারও চাকরি বাতিল হচ্ছে না। প্রত্যেকের চাকরি বহাল থাকছে। অর্থাৎ আগে যে ৩২ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল হয়েছিল, তা বহালই রইল। (Primary Teachers Recruitment Case)

আদালত আরও বলে, "চাকরি করার সময় এই প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ওঠেনি। এমন কোনও তথ্য সামনে আসেনি যে, পরীক্ষকদের বেশি নম্বর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কয়েকজন অসফল প্রার্থীর জন্য গোটা প্রক্রিয়ার ক্ষতি করতে দেওয়া যেতে পারে না। তাহলে অনেক সৎ প্রার্থীর গায়েও কালির ছিটে লেগে যাবে।" আদালত জানিয়েছে, দুর্নীতির তদন্ত যেমন চলছে চলবে। কিন্তু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কয়েকজনের জন্য গোটা প্রক্রিয়া বাতিল করা যায় না। 

Continues below advertisement

আদালতের রায়ের পর আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরী বলেন, "চাকরি বহাল থাকবে। সিঙ্গল বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ ছিল, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। তাই নিয়োগ বাতিল করা হল। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ সেই পর্যবেক্ষণকে মান্যতা দেয়নি। আদালত পরিষ্কার জানিয়েছে, নিরীহ শিক্ষক-শিক্ষিকারা দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন না। CBI ইতিমধ্যেই শনাক্ত করেছে, কারা বিশেষ ভাবে চাকরি পেয়েছিল। সেই তালিকাও রয়েছে। বাকি যাঁরা, কর্তৃপক্ষের ভুল বা কোনও দুর্নীতির জন্য নিরীহদের চাকরি যেতে পারে না। এতদিন যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের কথা ভেবে, যেহেতু তাঁরা কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তাই তাঁদের চাকরি বহাল থাকছে। রায়ের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি প্রকাশিত হলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।"

এই রায়ের পর মামলাকারী এক শিক্ষক, পাঁচুগোপাল দাস বলেন, "আদালত জানিয়েছে, ৩২ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা কোনও রকম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। ৩২ হাজার শুধু সংখ্যা নয়, তাঁদের পরিবারও রয়েছে। ন'বছর চাকরির পর কারও চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়, কী দুর্বিসহ অবস্থা হয়, তা বিবেচনা করেছে আদালত। এটা বিচার্য বিষয় ছিল। ৩২ হাজারকে এক নিমেষে, সিঙ্গল বেঞ্চে আমাদের পার্টি না করেই চাকরি বাতিল করে দেওয়া হয়। আজ সেই রায় খারিজ করে দিয়েছে আদালত। আমাদের পক্ষে রায় গিয়েছে।"

আদালত চত্বরে কেঁদেও ফেলেন চাকরিজীবী সুমন মিত্র। তিনি বলেন, "একটা কলঙ্কযুক্ত রায় ছিল, আজ কলঙ্কমুক্ত হলাম আমরা। আমরা কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। কষ্ট করে, পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছি। আজকের রায় বুঝিয়ে দিল, আমরা কোনও দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলাম না। আমরা আর কিছু বলতে চাই না। আজ আমরা সকলে খুশি।"

অন্য দিকে, আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি বলেন, "ডিভিশন বেঞ্চের রায় শিরোধার্য। এর পরের শুনানি বাকি। ইনডিভিজুয়াল মামলাগুলি, সিঙ্গল বেঞ্চকে আবার সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।"

আজকের এই রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সকলেই। কারণ ২০১৬ সালের SSC-তে ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে। নতুন যে নিয়োগ প্রক্রিয়া, তাকে চ্যালেঞ্জ করেও একাধিক মামলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে সেই সব মামলার শুনানি হচ্ছে। তাই ২০১৬-র ৩২ হাজারের চাকরি থাকবে কি না, প্রশ্ন উঠছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কারও চাকরি বাতিল করল না আদালত। অর্থাৎ সকাল থেকে যাঁরা দুশ্চিন্তায় ছিলেন, তাঁরা স্বস্তি পেলেন। স্বস্তি পেল রাজ্য সরকারও। কারণও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়ে। CBI, ED চার্জশিটও জমা দেয়।

২০১৪ সালের ‘TET’-এর ভিত্তিতে ২০১৬ সালে প্রাথমিকে প্রায় ৪২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। কিন্তু ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বেনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। 'বঞ্চিত' চাকরিপ্রার্থীরা আদালতে মামলা দায়ের করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ২০১৪ সালের 'টেট'-এ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তাঁরা। ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। ইন্টারভিউয়ে ডাক পর্যন্ত পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি হয়নি। ২০১৬ সালের প্যানেলে একাধিক অনিয়ম ছিল বলে জানান 'বঞ্চিত'রা। নিয়ম অনুযায়ী প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও, প্যানেলের বেশিরভাগ চাকরিপ্রার্থীই ছিলেন প্রশিক্ষণহীন। অর্থাৎ যোগ্যদের বঞ্চিত হতে হয় বলে অভিযোগ তোলা হয়।

সেই মামলায় ২০২৩ সালের ১২ মে রায় ঘোষণা করেন কলকাতা হাইকোর্টের তদানীন্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ৩২ হাজার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল তাঁর সিঙ্গল বেঞ্চ। সিঙ্গল বেঞ্চের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে যান প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং চাকরিহারারা। রায়ের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করে বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। তবে রায়ে বিচারপতিরা জানান, সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশ মতো নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্ষদকে শুরু করতে হবে। নিয়োগের সময়সীমা ৩ মাস থেকে বাড়িয়ে ৬ মাস করে ডিভিশন বেঞ্চ।

রায়ের ওই অংশকে চ্যালেঞ্জ করে আবার সুপ্রিম কোর্টে যায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। নতুন করে ৩২ হাজার শিক্ষক নিয়োগের হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। সেই সঙ্গে মামলা কলকাতা হাইকোর্টে পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট। মামলা ঘুরে বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চে গেলে, শুনানির আগে সরে দাঁড়ান বিচারপতি। এরপর মামলা যায় বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রর ডিভিশন বেঞ্চে। ১২ নভেম্বর শেষ হয় মামলার শুনানি। শেষে আজ রায় ঘোষণা হল।