ঋত্বিক প্রধান, পূর্ব মেদিনীপুর: এগরা থানার আকলাবাদ এলাকায় ২৫০ বছরেরও বেশি প্রাচীন 'বাসাবাড়ি’ কালীপুজোয় রয়েছে নানা মাহাত্ম্য। রয়েছে নানা জনশ্রুতি। পুজোয় নানা নিয়মকানুন মেনে চলা হয়। অন্যান্য সর্বজনীন পুজোর ভিড়ে বাসাবাড়ির পুজো বহুকাল ধরে একটি সম্পূর্ণ আলাদা ঐতিহ্য বহন করে আসছে। পুজোকে ঘিরে আনন্দে মেতে ওঠেন আয়োজক বসু চৌধুরী পরিবারের লোকজন ও এলাকার বাসিন্দারা। বাসাবাড়ির পুজোকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে আবেগ রয়েছে যথেষ্ট। এই আবেগকে সঙ্গী করেই নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে পুজো হয়ে আসছে। 

Continues below advertisement

বসু চৌধুরী পরিবারের সদস্য তুষার কান্তি বসু চৌধুরী তিনি জানা যায়, পিংলা থানার গোবর্ধনপুর গ্রামের জমিদার “রাম-গোবিন্দ বসু এই পূজার প্রবর্তন করেন। রাম-গোবিন্দ বসু ও তাঁর বংশধরগণ মেদিনীপুর জেলার পিংলা, পাঁশকুড়া ও সবং থানার অন্তর্গত কালীদান, মুরারিচক, উচিৎপুর, পেরুয়া, পিংলা, মুকসদপুর, মঙ্গলপুর, গোবর্দ্ধনপুর ইত্যাদি মৌজার জমিদারী লাভ করার পর তৎকালীন উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত এগরা থানার আলাবাদ, কশবা এগরা, গোপালচক, হাসিমপুর, পুরুষোত্তমপুর, মহেশপুর, দামোদরবাড়, কৈঁথোড়, সহ ১৬টি মৌজা জমিদারি ইংরেজ সরকারের নিকট হতে লাভ করেন।

রাম গোবিন্দ বসু পিংলা থানার গোবর্ধনপুরে বসবাস করলেও এগরা থানার জমিদারী দেখাশুনা, তত্ত্বাবধান, খাজনা আদায় করতে তাঁরা আকলাবাদ গ্রামে একটি অস্থায়ী বাসা বা গৃহ নির্মাণ করে বছরের কয়েক মাস বসবাস করতেন। তারপর গোবর্ধনপুরে চলে যেতেন। সেই থেকে ঐ জায়গার নাম হয় "বাসাবাড়ী"।

Continues below advertisement

তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে রামগোবিন্দ বসু, “চৌধুরী” পদবী লাভ করেন। একসময় এই এগরা এলাকা বঙ্গোপসাগরে তীরবর্তী এলাকা ছিল। সেই সময় এই আঁকলাবাদ এলাকায় ডাকাতরা মশাল জ্বালিয়ে কালীপুজো করত। কালীপুজোর পরে আবার তারা এই এলাকা থেকে পালিয়ে যেত। কয়েক বছর পরে এই এগরা এলাকা ইংরেজদের কাছ থেকে জমিদারি পাওয়ার পর রামগোবিন্দ বসু  তাঁদের বাস্তুতে গৃহ দেবতা শ্রীশ্রী মা দক্ষিণা কালী মাতার একটি মাটির মন্দির গড়েন যা প্রতি বছর কার্ত্তিক মাসে মহা আড়ম্বরের সঙ্গে (মূর্তি সহকারে) অদ্যবধী পূজা হয়ে আসছে।দেবীর  সেবা বা পূজার জন্য ব্রাহ্মণের এই গ্রামে বসবাস না থাকায় উড়িষ্যা থেকে ৪টি ব্রাহ্মণ পরিবার ও কয়েকটি হরিজন পরিবারকে যথা যোগ্য মর্য্যাদা সহকারে এই আকলাবাদ গ্রামে আনেন। এঁদের বসবাসের বাস্তু, চাষাবাদের জল জমি, পুষ্করিণী দান বা জাইগির হিসাবে বন্দোবস্ত করে দেন। 

কথিত আছে, বাসাবাড়ির দক্ষিণাকালী মায়ের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এখানে মায়ের কাছে বলির মানত করে অন্ধ তার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন। বোবা তার বাকশক্তি ফিরে পেয়েছেন। নারীরা সন্তান লাভ করেছেন। এমনকী হারিয়ে যাওয়া সন্তান-সন্ততিকে ফিরে পেয়েছেন অনেকেই। ভক্তদের মনস্কামনা পূরণ হলেই তাঁরা মায়ের কাছে পাঁঠা বলি দেন।  ব্রাহ্মণরাই এখানে ভোগ তৈরি করেন। আগে প্রদীপ আর মশাল জ্বালিয়ে পুজো হতো। বর্তমানে মশাল জ্বালিয়ে নয়, জেনারেটরের আলোতেই পুজো হয়। পুজোকে ঘিরে সেজে উঠে বাসাবাড়ি কালীমন্দির চত্বর। এই পুজোই এগরার প্রাচীনতম কালী পূজা যা বাসাবাড়ীর কালী পূজা হিসাবে পরিচিত। সেই পুজো আজও প্রাচীন রীতিনীতি মেনে হয়ে আসছে। বর্তমানে বসু চৌধুরী পরিবার খণ্ড খণ্ড হয়েছে। একটি পরিবার আবার আলাদা পুজোও করে। বহুকাল আগে খড়ের চালার  মাটির মন্দির থাকলেও বর্তমানে পাকার মন্দির রয়েছে। জমিদারি প্রথা না থাকলেও বাসাবাড়ির কালীমন্দিরে রয়ে গিয়েছে সেকালের পুজোর নানা প্রাচীন নিয়মকানুন। পুজোর আগে মা’কে রুপোর মুকুট, রুপোর খড়্গ ও স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত করা হয়। পুজোর সূচনাকাল থেকে আজও পাঁঠাবলির প্রথা রয়েছে। কালীপুজোর দিন যেমন মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষের ভিড় জমে যায়, তেমনি পাঁঠাবলি দেখতেও ভিড় জমে যায়।