৯ অগাস্ট, আর জি কর মেডিক্যালে ইর্মাজেন্সি বিল্ডিংয়ের সেমিনার রুমে চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই পুলিশের তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করেছিল নির্যাতিতার পরিবার। সুপ্রিম কোর্টে তারিখের পর তারিখ পড়লেও, সিবিআই তদন্তে ভরসা রেখেছিলেন নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা। কিন্তু আর জি করে খুন ও ধর্ষণ মামলায় সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের জামিন হয়ে যাওয়ার পর, সিবিআই তদন্ত নিয়ে ছত্রে ছত্রে উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন।  চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিটই দিতে পারেনি সিবিআই। অন্যদিকে, প্রায় ৩ মাস পর, ১৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে আর জি কর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। এরই মধ্যে আর জি কর মেডিক্যালে  নিহত তরুণী চিকিৎসকের পরিবার নতুন করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক,  আর জি করের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার, কোথা থেকে কোথায় গড়াল ?   



  •  ৯ আগস্ট । রাজ্যে নজির বিহীন ঘটনা। ভয়ঙ্কর  বর্বরতার ছবি। এ রাজ্যের প্রথম সারিতে থাকা অন্যতম  মেডিক্যাল কলেজ আর জি করের সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হল মহিলা ডাক্তারি পড়ুয়ার মৃতদেহ। যা প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালাতে চেয়েছিল হাসপাতাল। পরে সবটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

  • ৯ তারিখ আর জি কর হাসপাতালে যান তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল।  তদন্ত শুরু করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার হয় এই মামলায় এখনও পর্যন্ত একমাত্র অভিযুক্ত, যার বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠন করেছে অধুনা তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিবিআই। 

  • কলকাতা পুলিশ জানায়, ছেঁড়া ব্লুটুথ হেড ফোনের তার আর সিসিটিভি ফুটেজই ধরিয়ে দেয় আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মূল অভিযুক্তকে। সিসিটিভি ফুটেজে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে শনাক্ত করেন একজন হোমগার্ড। এরপরেই সঞ্জয়কে আটক করে পুলিশ। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। 

  • তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পরেই বিক্ষোভ আন্দোলনের পথে নামেন আর জি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা। কলেজে নিরাপত্তার অভাব ও থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে সরব হন তাঁরা। দাবি করা হয় অধ্যক্ষের পদত্যাগ। শুরু হয় বাংলাব্যাপী জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। 

  • এরপর ১২ অগাস্ট হাসপাতালের সুপারের অপসারণের পর  আর জি কর কাণ্ডে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ  ইস্তফা দেন। পরে স্বাস্থ্যভবনে গিয়ে ইস্তফা জমা দিন তিনি। 

  • ইস্তফা গ্রহণ না করে সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ নিয়োগ করতে চায় রাজ্য । সেখানেও শুরু হয় পড়ুয়া - বিক্ষোভ। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ভবন থেকে আরজি করের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয় সুহৃতা পালকে। আরজি কর মেডিক্যালের এমএসভিপি করা হয় বুলবুল মুখোপাধ্যায়কে। 

  • আর জি কর আন্দোলন ধীরে ধীরে বিরাট এক নাগরিক আন্দোলনের চেহারা নেয়। ১৪ অগাস্ট সারা বাংলা ব্যাপী রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়। সারা বাংলায় এক নজির বিহীন নাগরিক আন্দোলন দেখে বিশ্ব। 

  • সেদিনই মধ্যরাতে ৪০ মিনিট ধরে তাণ্ডব চলে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। তছনছ করে দেওয়া হয়, জরুরি বিভাগ সহ একাধিক বিভাগ।  ভেঙে ফেলা হয় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মঞ্চ। একাধিক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। 

  • পথে নামেন নির্যাতিতার মা-বাবাও। জানালেন, রাজ্য পুলিশে তাঁদের আস্থা নেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল সিবিআই চান তাঁরা। আর জি কর কলেজে ধর্ষণ, খুনের বীভৎস ঘটনায়  কলকাতা পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি কলকাতা হাইকোর্টও।  তদন্তভার তুলে দেওয়া হন CBI-এর হাতে।

  • এরইমধ্যে চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের পাশাপাশি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও ওঠে। অভিযোগ আনেন প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। 

  • আর জি কর হাসপাতালে  চিকিৎসক ধর্ষণ-খুনের মামলা কলকাতা হাইকোর্ট থেকে যায় সুপ্রিম কোর্টে।  এই মামলায় CBIকে স্টেটাস রিপোর্ট  দিতে বলা হয় সুপ্রিম কোর্টকে। আর জি কর মেডিক্যালে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় CISF।  ভয়াবহ ঘটনা, বীভৎস ঘটনা, শুনানিপর্বে মন্তব্য করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। 

  • আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে নেমে আর জি করন মেডিক্যালে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের পাশাপাশি তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে CBI। 

  • এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর ডাক্তারি পড়ুয়া খুনে  প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও টালা থানা ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই।  

  • ২ সেপ্টেম্বর পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফার দাবিতে লালবাজার অভিযানকরেন জুনিয়র ডাক্তাররা। ফুল, শিরদাঁড়া হাতে লালবাজারে পৌঁছন তাঁরা। অভিযান আটকাতে লৌহ কপাট বসানো হয়। পরে অবশ্য তাঁদের জেদের সামনে হার মানে পুলিশ। একেবারে বিনীত গোয়েলের হাতে গিয়ে প্রতীকী শিরদাঁড়া তুলে দিয়ে আসেন আন্দোলনকারীরা। 

  • এরপর টানা ৯ দিন স্বাস্থ্যভবন চত্বরেই পড়ে থাকেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। এরমধ্যে দফায় দফায় মেল চালাচালি। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ঠিক হওয়ার পরও লাইভ স্ট্রিমিং-এর প্রশ্নে দুয়ার থেকে জুনিয়র চিকিৎসকদের ফিরে আসেন। শেষমেষ খোদ মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছে যান অবস্থান মঞ্চে। 

  • পরে ১৬ সেপ্টেম্বর কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর সুরক্ষার বিষয় নিয়ে ফের নবান্নে মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা। তবে দু-পক্ষই একে অপরের কার্যবিবরণীতে সই করতে সম্মত হয়নি। এরপর স্বাস্থ্য়ভবনের সামনে থেকে ধর্না তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জুনিয়র ডাক্তাররা। পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল, স্বাস্থ্য অধিকর্তা  ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকে সরানোর কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সরানোর কথা বলা হয় DC নর্থ অভিষেক গুপ্তকেও।

  • ১৯ সেপ্টেম্বর আংশিক কর্মবিরতি তুলে নিয়ে কাজে ফেরেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। 

  • এরপর ১০ দফা দাবি নিয়ে ধর্মতলায় ১৭দিন অনশন চালিয়ে যান জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা। এই পর্যায়ে কেউ কেউ বিশেষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ২১ অক্টোবর আর জি কর মেডিক্যালের নিহত চিকিৎসকের মা-বাবার অনুরোধে ১৭ দিন পর  জুনিয়র ডাক্তাররা অনশন তুলে নেন। তার আগে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর, রাতে ধর্মতলার মঞ্চ থেকে অনশন প্রত্যাহারের ঘোষণা করলেন তাঁরা। ১৭ দিন পর অনশন তুললেও, ন্যায়বিচার-সহ ১০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন জুনিয়র ডাক্তাররা।  

  • এদিকে শিয়ালদা আদালতে আর জি কর হাসপাতালে খুন-ধর্ষণ মামলার শুনানি চলতে থাকে। অন্যদিকে আর জি করের সবকটি মামলার ওপর নজর রাখছে সুপ্রিম কোর্ট। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে চার-চারটে মাস। কিন্তু বিচার এখনও অধরা। 

  •  CBI ৯০ দিনে চার্জশিট দিতে না পারায়, শুক্রবার ধর্ষণ, খুনের মামলা থেকে জামিন পেয়েছেন আর জি কর মেডিক্যালের প্রাক্তন অধ্য়ক্ষ সন্দীপ ঘোষ  এবং টালা থানার প্রাক্তন OC অভিজিৎ মণ্ডল। 

  • অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার আচমকাই সরে দাঁড়িয়েছেন।

  • সঞ্জীব খান্না নতুন প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সেই বেঞ্চ বদলে গেছে।  প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ প্রথমবার এই মামলা শুনে, পরবর্তী তারিখ দিয়েছে  মার্চ মাসে।  

  • এরই মধ্যে সিবিআই তদন্তে হতাশ নির্যাতিতার মা - বাবা আবার কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। মেয়ের খুনের নতুন করে তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা। তাঁদের আশঙ্কা, তদন্তের নামে তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে যেতে পারে। অনুমতি দিয়ে CBI-কে এই মামলায় যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।  

    আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।