প্রকাশ সিন্হা, উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা : মাথায় ছিলেন সন্দীপ ঘোষ। আর দুই বাহু ছিলেন সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থার মালিক বিপ্লব সিংহ ও সুমন হাজরা। এভাবেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কাজ করেছিল 'দুর্নীতির ট্রায়াঙ্গল'। চার্জশিটে এমনই বিস্ফোরক দাবি করেছে CBI।


বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের এই অংশটা যেমন রহস্যময়, তেমনি ভয়ঙ্কর। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজেও কি কাজ করেছিল 'দুর্নীতির ট্রায়াঙ্গল' ? অন্তত আদালতে জমা দেওয়া CBI-এর চার্জশিটে তেমনই দাবি করা হয়েছে।

আর জি কর মেডিক্যালে দুর্নীতির তদন্তে নেমে ২৯ নভেম্বর, আলিপুরের বিশেষ CBI আদালতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তরফে যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, সেখানে 'দুর্নীতির ত্রিভুজ' হিসেবে যাদের তুলে ধরা হয়েছে, তার মাথায় রয়েছেন আর জি কর মেডিক্যালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, হাসপাতালে সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থার দুই মালিক বিপ্লব সিংহ এবং সুমন হাজরা। সন্দীপের পাশাপাশি তাঁদেরকেও গ্রেফতার করেছে CBI। সব মিলিয়ে ওই দুই ব্যক্তির সংস্থাকে বিশেষ সুবিধা দিতে ৬ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকার বরাত পাইয়ে দিয়েছিলেন সন্দীপ ঘোষ। অর্থাৎ তিনি প্রায় ৭ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে চার্জশিটে দাবি করেছে CBI।

তরুণী চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের ঘটনার পর, সামনে আসে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনাও। চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি দুর্নীতির তদন্তভারও CBI-কে দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। আর তদন্তে নেমেই CBI জানতে পারে, 'দুর্নীতির ত্রিভুজ' তৈরি হয়েছিল সাত বছর আগে। যখন, ২০১৭ সালে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের MSVP বা মেডিক্য়াল সুপারিনটেন্ডেন্ট করে পাঠানো হয় সন্দীপ ঘোষকে। CBI-এর চার্জশিটেও তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা আছে।

সন্দীপ ঘোষ ন্যাশনাল মেডিক্যালে থাকাকালীন কীভাবে সুমন ও বিপ্লবদের বরাত বৃদ্ধি পেয়েছিল, কীভাবে তাঁদের 'cartel'-কে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল, চার্জশিটে তাও টেবিল করে তুলে ধরেছে CBI। সেখানে দেখানো হয়েছে, ২০১৬-১৭ সালে ন্যাশনাল মেডিক্যালে সুমন ও বিপ্লবের সংস্থা কোনও বরাত পাননি। ২০১৭-'১৮ সালে, অর্থাৎ সন্দীপ ঘোষ MSVP থাকাকালীন সেই বরাতের পরিমাণ এক লাফে হল ২ লক্ষ ৩ হাজার ২৮০ টাকা। ২০১৮-'১৯-এ সেই বরাতের পরিমাণ ৮ গুণ বেড়ে হল ১৬ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৩৭ টাকা। অর্থাৎ গত বারের থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা বেশি (১৪ লক্ষ ৮২ হাজার ৫৫৭)। পরের অর্থবর্ষে (২০১৯-২০) তা আরও প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ বেড়ে দাঁড়ায়, ২৮ লক্ষ ২০ হাজার ২৫০ টাকায়। তার পরের বছর (২০২০-২১) বরাতের টাকার অঙ্ক গিয়ে পৌঁছয় ৫০ লক্ষের কাছাকাছি। (৪৫ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬১ টাকা)।

এর পরের বছর থেকেই এই উত্থানে কার্যত ধস নামে। কারণ, ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। CBI-ও তাদের চার্জশিটে তুলে ধরেছে, যখন সন্দীপ ঘোষ ন্যাশনাল মেডিক্যাল ছেড়ে চলে আসেন, তখন জোরালো ধাক্কা খান সুমন হাজরা ও বিপ্লব সিংহরা। ২০২০-'২১ অর্থবর্ষে তাদের বরাত পাওয়ার পরিমাণ যেখানে ৪৫ লক্ষ টাকার উপরে ছিল, সেখানে ২০২১-২২-এ তা এক ধাক্কায় নেমে আসে ২১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬০ টাকায়। পরের বছর (২০২২-২৩) তা একেবারে তলানিতে চলে আসে। ৩ লক্ষ ১১ হাজার ১৪০ টাকা। সব মিলিয়ে, ওই ৮ বছর ন্যাশনাল মেডিক্যাল থেকে ১ কোটি ১৭ লক্ষ ৮৬ হাজার ৬২৮ টাকার বরাত পেয়েছিল বিপ্লব-সুমনের সংস্থা।