সন্দীপ সরকার ও ঝিলম করঞ্জাই, কলকাতা : এদের বাড়ি বিভিন্ন জায়গায়। প্রত্য়েকেই আলাদা আলাদা মতাদর্শের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। মিল বলতে একটাই, এরা সবাই জুনিয়র ডাক্তার। গত ৩৯ দিন ধরে, এদের ডাকেই সাড়া দিয়ে, রাজ্য়ের কোনায়-কোনায় পথে নামছে নাগরিক সমাজ। এরাই রোদ-জল-ঝড় উপেক্ষা করে, রাজ্য়ের স্বাস্থ্য়ব্য়বস্থার খোলনলচেটা বদলানোর জন্য় লড়াই করছেন, দৃপ্তকণ্ঠে বিচার চাইছেন। 


লালবাজার অভিযানে জুনিয়র চিকিৎসকদের শিরদাঁড়ার জোর খুলে দিয়েছিল পুলিশের লৌহকপাট। স্বাস্থ্য ভবন অভিযানে তাঁদের মস্তিষ্ক, চোখ হাতে মিছিল, মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছিল এভাবেও ভাবা যায় ? বাড়ি আলাদা আলাদা জেলায়...আলাদা আলাদা জায়গায়...মতাদর্শগতভাবেও নানা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
পড়াশোনাও ভিন্ন ভিন্ন মেডিক্য়াল কলেজে। কিন্তু, গত ৩৯ দিন ধরে, এরা নিজেরাই একজোট হয়ে, একজোট করেছে গোটা বাংলাকে। এদের পরিচয় এখন একটাই, এরা আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার। যারা শক্তিমান সরকারকেও ঝুঁকতে বাধ্য় করেছে।

হুগলির বলাগড়ের খামারগাছি গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস হালদার। শুরু থেকেই আন্দোলনের প্রথম সারিতে। কলকাতা মেডিক্য়াল কলেজের অ্যানাস্থেসিয়া বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট দেবাশিস। মাধ্যমিকে অষ্টম, উচ্চ মাধ্যমিকে একাদশ স্থান অধিকার করেছিলেন। ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত দেবাশিস হালদারের দাবি, এই আন্দোলনে মতাদর্শের কোনও জায়গা নেই।


কলকাতা মেডিক্য়াল কলেজের সিনিয়র রেসিডেন্ট ও আন্দোলনকারী দেবাশিস হালদার বলেন, 'আজ যে WBJDF তৈরি হয়েছে এখানে সবাই রয়েছে। প্রত্যেকের নানা ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। এখানে এমন অনেক রয়েছেন যাঁরা আগে স্টুডেন্ট ইউনিয়নে ছিলেন। কেউ তৃণমূল করতেন, কেউ সিপিএম করতেন, কেউ DSA করতেন বা অন্য বাম সংগঠন করতেন। এমনও আছেন কে কিছু করতেন না। আমাদের কাছে ন্যায়বিচারের দাবিটাই মূল মনে হয়েছে।'

একই মত, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক পড়ুয়া গৌরাঙ্গ প্রামাণিকের। বাবা বিড়ি কারখানার শ্রমিক। পরিবারের প্রথম স্নাতক গৌরাঙ্গ প্রামাণিক। তিনি বলেন, 'গ্রামের মানুষের যে সংবেদনশীলতা, স্বাস্থ্যের যে আকুতি ...সেই জায়গা থেকেই আমাদের বেড়ে ওঠা। ডাক্তারিতে পড়তে আসার মতো শপথ। আমিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট। আমার আগে আমার বংশের কেউ গ্র্যাজুয়েট হয়নি। তাই আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।'


একেবারে প্রথম সারিতে থাকা লহরী সরকারের আন্দোলনের সঙ্গে পরিচয়ই এই প্রথম। জীবনে রাজনীতি করেননি। আরজি কর মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক পড়ুয়া লহরী বলছেন, প্রথম দিকে আন্দোলনে নামায় সায় ছিল না পরিবারেরও। তাঁর বক্তব্য, সবসময় আমার মা খুব চিন্তায় থাকেন। সারাক্ষণ ফোন করেন। এনিয়ে বাড়িতে টুকটাক ঝামেলাও হয়েছে। এই ঘটনার পর ফোন করার ফ্রিকোয়েন্সি আরও বেড়ে যায়। মানে হয়ত, আমার মা দু'ঘণ্টা অন্তর ফোন করে খবর নিচ্ছেন। কেন টিভির সামনে আসছি বারবার। 


ঝাড়গ্রামের শিলদায় বাড়ি অনিকেত মাহাতোর। আন্দোলনে একেবারে প্রথম সারিতে। জয়েন্টে প্রস্তুতির জন্য কোচিং নিতে ২০১১-য় কলকাতায় আসা। যে বন্ধুর বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করতেন, তিনি জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ব়্যাঙ্ক করেছিলেন ৯.., আর অনিকেতের ব়্যাঙ্ক হয়েছিল ৫৫৭। তিনি বলেন, 'ন্যায়বিচারের দাবিতে যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে কাউকে না কাউকে সামনে আসতেই হয়। সেই হিসাবে ঘটনাক্রমে আমি চলে এসেছি। তাই হয়ত আমাকে মুখ বলে মনে হচ্ছে। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ আসতেন এবং ন্যায়বিচারের দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারতেন, তাহলে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতে পারতেন।'

পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা এরেন্দা গ্রামের বাসিন্দা কিঞ্জল নন্দের। বর্তমানে আরজি কর মেডিক্য়াল থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে MD করছেন। ইতিমধ্য়েই অভিনয় করেছেন ১২টি সিনেমাতেও। আন্দোলনরত এই জুনিয়র চিকিৎসক বলেন, 'বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছেলে-মেয়েরা যেমন আছেন, সেরকম আমার মতো অনেক ছেলে-মেয়ে আছেন, যাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের থাকেন না। আসলে আমার মনে হয় যে, এটি এমন একটি সংবেদনশীল জায়গা এখানে কোনও রং বিচার্য নয়।'

রাজনীতির সঙ্গে যোগ নেই, তবে অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করাটা রক্তে আছে, বলছেন আসফাকুল্লা নাইয়া। আন্দোলনরত এই জুনিয়র চিকিৎসকের বক্তব্য, 'দুই বছর আগে বাবা এক্সপায়ার করে গেছেন। মা বাড়িতে আছেন। গৃহবধূ। আমাদের এই আন্দোলন যেমন বিচার চাওয়ার আন্দোলন, তেমন অন্যায় যেখানে যেখানে হচ্ছে, সমস্ত জায়গার বিরুদ্ধে আমাদের এই আন্দোলন। '

তবে এঁরা প্রত্য়েকেই বলছেন মুখ আসল নয়, আসল হচ্ছে টিম। ব্য়ক্তি বড় নয়, জয় টিমের।