সমীরণ পাল, অনির্বাণ বিশ্বাস, শিবাশিস মৌলিক: মতুয়া কার্ড ও ধর্মীয় শংসাপত্র বিলি ঘিরে দ্বন্দ্ব। আর সেই নিয়েই ফাটল চওড়া হওয়ার আশঙ্কা। মতুয়া ভোটকে সামনে রেখে ঠাকুরনগরের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যাচ্ছে বলে জল্পনা তুঙ্গে। শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে মমতাবালা ঠাকুরের দ্বারস্থ হলেন সুব্রত ঠাকুর এবং তাঁর মা ছবিরানি ঠাকুর। (Shantanu Thakur-Subrata Thakur)
বিজেপি-র সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু এবং তাঁর দাদা, বিজেপি বিধায়ক সুব্রতর মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। জল এতদূর গড়িয়েছে যে, পরস্পরকে নিশানা করে ঝাঁঝাল আক্রমণও শানালেন তাঁরা। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের মহাসঙ্ঘাধিপতি তথা গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রতর দাবি, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাট মন্দিরে কার্ড বিতরণের নামে ওই জায়গা দখল করছেন ভাই শান্তনু। (Matua Mahasangha)
এই আবহে জল্পনার আগুনে ঘি ঢেলেছে একটি ভিডিও, যেখানে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা, বাগদার তৃণমূল বিধায়ক মধুপর্ণা ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনায় বসতে দেখা গিয়েছে সুব্রত এবং তাঁর মা ছবিরানিকে। শনিবার রাতে তাঁদের মধ্যে বৈঠক হয়।
সেই নিয়ে জল্পনার মধ্যেই ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন সুব্রত। তাঁর বক্তব্য, "নাটমন্দিরটা হরি মন্দিরের সামনে। একদিন কিছু করলে আলাদা ব্যাপার। পাকাপাকি হলে ভক্তরা কোথায় যাবে? শান্তনু আমাকে বলছে, আমি উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমার কোনও অধিকার নেই মতুয়া মহাসঙ্ঘে। মন্ত্রিত্বের জোরে হুমকি দিয়ে বলছে, 'তোকে কে টিকিট দেয় আমি দেখব'। মাকে গালাগালি দিয়েছে ও। মাকেও হুমকি দিয়েছে।"
সুব্রতর অভিযোগ যদিও খারিজ করে দিয়েছেন শান্তনু। তাঁর অভিযোগ, দলবদলের জন্যই এসব 'নাটক' করছেন দাদা। তাঁর কথায়, "নেতাজি ইন্ডোরে অমিত শাহ বলে গিয়েছেন, 'CAA আবেদন করা লোকজনকে আবেদন করতে বলুন। নাগরিকত্ব দেওয়ার দায়িত্ব আমার'। আমি সেই অনুমতিতে কাজ করছি। এটা নিয়ে বাইরে থেকে কে এসে গন্ডগোল করবে, তা নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলব না। আমি অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছি। সুব্রত ঠাকুর, মমতা ঠাকুর মিলে আমাকে গালাগালি দিচ্ছে যাচ্ছেতাই ভাবে। আইনত এ নিয়ে ব্যবস্থা নেব আমি।"
ভাই মন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় সুব্রত হিংসে করছেন, তৃণমূলে যাওয়ার ছক করছেন বলেও দাবি করেন শান্তনু। তাঁর কথায়, "সুব্রত ঠাকুর রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের জন্য এই নাটক করছেন। আমি জেতার পর হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। অধিকার দাবি করছেন। আর এখন হিংসের কারণ হচ্ছে, শান্তনু ঠাকুর কেন উপরে উঠে গেল? শান্তনু ঠাকুর কেন মন্ত্রী হল? আমি কেন হতে পারছি না? আমাকে হতে গেলে কী করতে হবে! বিজেপি-তে বিধায়ক থেকে মন্ত্রী হওয়া যায় না। তাই তৃণমূলে যেতে হবে। একটা নাটক করতে হবে যাতে লোক জড়ো হয়, সমবেদনা জোগাড় করতে পারি যে শান্তনু বঞ্চিত করছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে, শুধু পতাকা ধরেনি।"
পাল্টা শান্তনুর বিরুদ্ধেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন সুব্রত। তাঁর কথায়, "২০২৪ সালে টিকিট না পেলে (শান্তন) ও তৃণমূলে যেত। ওর মনে এটাই ছিল। কোনও কিছু হলে...তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়ে রেখেছে। আমার কী! ও আমাকে বলে, 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও'। আমার জেঠিমা মমতাবালা এবং বোনের সঙ্গে মাকে নিয়ে কথা বলেছি। রাজনীতি পরে, আগে পরিবার।"
এ নিয়ে মমতাবালা বলেন, "বড় ছেলের কোনও অধিকার নেই! নাটমন্দিরে বসে হিন্দু কার্ড দিচ্ছে। মতুয়াদের হিন্দু বানাচ্ছে। আমি বলতে গেলাম যে, ভক্তদের জায়গা এটা। যার যার বাড়ির সামনো করো। নাটমন্দিরে এলে সুব্রতও জায়গা পাবে। দুই ভাইয়ের সমানাধিকার। আমার কাছে এসেছিল বলে আমি নিজের কর্তব্য পালন করেছি।"
ভাইয়ে-ভাইয়ে এই দ্বন্দ্বে সুব্রত ও শান্তনুর মা-বাবাও ভিন্ন অবস্থানে। মায়ের দাবি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাঁর। দুই ভাইয়ের সমান অধিকারের জন্যই মমতাবালার কাছে ছুটে যান তিনি। কিন্তু বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের দাবি, শান্তনুর নামে মিথ্যে অভিযোগ করা হচ্ছে। তাঁর অনুমতিতেই মতুয়া কার্ড ও ধর্মীয় শংসাপত্র বিলির কাজ করছেন শান্তনু।
কিন্তু ভাইয়ে-ভাইয়ে এমন অশান্তিতে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মতুয়াদের মধ্যে। রাজনীতির ময়দানে দুই ভাই একই দলে থেকে যেভাবে বিপরীত অবস্থান নিচ্ছেন, তা নিয়ে নানা জল্পনাও শুরু হয়েছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলবদলের সম্ভাবনা জোরাল হচ্ছে আরও।