বালুরঘাট : ছত্রে ছত্রে ঐতিহাসিক নির্দশন (Historical Signs)। পাল ও সেন বংশের ছোঁয়া। লোকসংস্কৃতির ইতিহাস। স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটা সমৃদ্ধ জেলা বলতে যা যা থাকা উচিত তার প্রায় সবই রয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় (South Dinajpur District)। আর্থিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার একটু উন্নতি হলেই, এই জেলার রাজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হয়েছে উঠতে পারে। এহেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সামগ্রিক চিত্র দেখে নেওয়া যাক একনজরে...
ইতিহাস : প্রায় ২ হাজার বছরের ইতিহাস-সমৃদ্ধ দিনাজপুর অঞ্চল। এর অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন পুন্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে। ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্য আমলে এই দিনাজপুর অঞ্চলে জৈন ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। মৌর্যসম্রাট অশোকের জৈনগুরু ভদ্রবাহু এই দিনাজপুরের কোটিপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই কোটিপুরই বর্তমানের দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে, পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল ও তাঁর উত্তরসূরী মহীপালের আমলে এই অঞ্চলে একাধিক কুয়ো ও দিঘি খোঁড়া হয়। যার প্রমাণ পাওয়া যায় অধুনা কুশমণ্ডি, গঙ্গারামপুর, বংশিহারী ও তপনের মতো এলাকায়। পাল-দের পর সেন-বংশ এই দিনাজপুর অঞ্চল শাসন করে। মুঘল আমলে এখানে জমিদারি প্রথা চালু হয়। কিন্তু, তাতেও এই এলাকার বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। এরপর ব্রিটিশ শাসনের আওতাভুক্ত হয় দিনাজপুর। অষ্টাদশ শতকে এখানে জমি জায়গা দিয়ে সন্ন্যাসী ফকিরদের বসতি গড়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও এই জেলার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই জেলা নিজের স্থান ধরে রাখে। বঙ্গভঙ্গের সময় এখানকার মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন।
অবস্থান : কথিত আছে, জনৈক দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাম অনুসারেই এখানকার নামকরণ করা হয় । দেশভাগের পর দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ পশ্চিম দিনাজপুর নামে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হলেও, তার দক্ষিণাংশ নিয়ে পরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল পশ্চিম দিনাজপুর জেলা দু'ভাগে ভাগ হওয়ার পর, জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা স্থাপিত হয়। বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর মহকুমা নিয়ে এই জেলা গড়ে উঠেছে। এই জেলার সিংহভাগ সীমানা বাংলাদেশের সঙ্গে ৷ দক্ষিণে পশ্চিমে মালদা জেলা ও পশ্চিমে উত্তর দিনাজপুর জেলা রয়েছে।
ভূ-পরিচয় : মূলত সমতল এই জেলাটি। তবে দক্ষিণ দিকে সামান্য নিচু। পুরানো পলিমাটি দিয়ে গঠিত । জেলাটি দুটি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত- উত্তরের মহানন্দা সমভূমি ও দক্ষিণ-পূর্বে বালুরঘাট অঞ্চলের সমভূমি। এই জেলার ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছে বনভূমি। রয়েছে কৃষি উপযোগী উর্বর মৃত্তিকাও।
অর্থনীতি : এই জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। জেলার একটা বড় অংশের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস- আখ, পাট ও তৈলবীজ। শিল্প সেঅর্থে প্রসার লাভ করেনি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। বালুরঘাট শিল্পাঞ্চল ছাড়া বড় বা মাঝারি শিল্পাঞ্চল নেই বললেই চলে। তবে, এখানকার পর্যটনশিল্প জেলার অর্থনীতির অন্যতম উৎস। এখানে স্থলবন্দর হিলি, বিভিন্ন প্রত্নস্থল ও প্রাচীন যুগের রাজাদের নানা কীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়।
রাজনীতি : একসময় বামেদের শক্তঘাঁটি। এখন অবশ্য ঘাসফুলের দাপট। বিজেপির সংগঠনও এখানে খারাপ নয়। ২০১৯ সালে এখানে বালুরঘাট আসন দখল করে বিজেপি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটেও এখানে ভাল ফল করেছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু, সেই হাওয়া এখন অনেকটাই থিতু হয়ে গেছে। অন্যদিকে, ২০১১ সালের আগে কোনও দিনই তৃণমূলের হয়নি দক্ষিণ দিনাজপুর। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন হোক বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, সেঅর্থে এই জেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ঘাসফুল শিবির। এমনকী ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটে সাফল্য মিললেও, এনিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া জেলা তৃণমূলে দীর্ঘ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাসও রয়েছে। যার প্রভাব পড়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। এমনই বলছে রাজনৈতিক মহল। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটেও তৃণমূল-বিজেপি কার্যত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩-এর পঞ্চায়েতে ভোটে কোন দলের পালে হাওয়া লাগে সেটাই এখন দেখার।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : সম্প্রতি এই জেলায় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। ২০০৮ সালে এই জেলায় রেলযাত্রার শুরু। ওই বছর মালদার একলাখি থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সদর বালুরঘাট পর্যন্ত রেলপথের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। দক্ষিণ দিনাজপুরে রেলপথের দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য রেলস্টেশন হল- বালুরঘাট, বুনিয়াদপুর ও গঙ্গারামপুর স্টেশন।
দক্ষিণ দিনাজপুরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সেরকম উন্নত নয়। সাম্প্রতিকালে এখানে ৫১২ নম্বর জাতীয় সড়ক তৈরি হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য জেলায় ৮৩ কিলোমিটার। এছাড়া রয়েছে ১০ নম্বর রাজ্য সড়ক এবং একাধিক জেলা ও গ্রামীণ সড়ক। মালদা, শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ এবং উত্তরবঙ্গের অন্যান্য প্রধান শহরের সঙ্গে ইতিমধ্যে রাস্তা দিয়ে সুসংযুক্ত।
তবে, এই জেলায় একটি বিমানবন্দর রয়েছে। বালুরঘাট বিমানবন্দর। যা বালুরঘাট শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্তমানে এই বিমানবন্দর থেকে বিমান পরিষেবা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে।
পর্যটন : এই জেলার পর্যটনশিল্প তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ। এখানকার গঙ্গারামপুর ব্লকের বানগড় ঐতিহাসিকভাবে সম্ভবত জেলার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এখানে। কোটি বর্ষা জেলার রাজধানী বানগড়। গুপ্ত আমলে, পুরো উত্তরবঙ্গ পুন্ড্র বর্ধন ভুক্তি(প্রদেশ) নামে পরিচিত ছিল। যা একাধিক জেলায় বিভক্ত ছিল। এই জেলাগুলির অন্যতম ছিল কোটি বর্ষা। যার পুরনো নাম দেবকোট।
হিলি ব্লক : ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বর্ডার চেকপোস্টের জন্য বিখ্যাত। যা বালুরঘাট জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাজ্যসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত। হিলি যাওয়ার পথে রাস্তার পাশ দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত দেখা যায়। বর্তমান সময়ে, শ'য়ে শ'য়ে ট্রাক পণ্য নিয়ে যাতায়াত করে। এই মুহূর্তে সেখানে, পর্যটকদের থাকার জন্য একটি পিডব্লুডি বাংলো রয়েছে।
সারংবাড়ি জঙ্গল : এই জঙ্গল এখানকার অন্যতম পিকনিক স্পট। রয়েছে কুঁড়ে ঘর। পর্যাপ্ত পানীয় জেলার ব্যবস্থ আছে। এই জঙ্গলে ঢুকতে বিডিও-র অনুমতি প্রয়োজন।
বালুরঘাট শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দোগাছি জঙ্গল নামে আরও একটি জঙ্গল।
জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান বালুরঘাট কলেজ মিউজিয়াম। প্রাচীন যুগের মুদ্রা, শিলালিপি, ভাস্কর্য্য, পোড়ামাটি, শোভাময় পাথর ইত্যাদি অনেক প্রাচীন সংগ্রহ এখানে সংরক্ষিত আছে।
গঙ্গারামপুর শহরের এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ধল দিঘি। পাল বংশের আমলে খনন করা এই দিঘিটির দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার।
ধল দিঘি থেকে ২০০ মিটার দূরেই রয়েছে কালা দিঘি। যা ধল দিঘির মতো লম্বা। জলের রং কালো হওয়ায়, এই দিঘির নাম কালা দিঘি। শীতে বহু পরিযায়ী পাখি এখানে জমায়েত করে।
গঙ্গারামপুর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ও বালুরঘাটের অদূরে রয়েছে মহীপাল হ্রদ। পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় মহিপাল এর খনন করিয়েছিলেন।
অন্যান্য : এই জেলায় ২টি মহকুমা রয়েছে- বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর মহকুমা। মোট আটটি ব্লক। ব্লকগুলি হল- বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর, তপন, কুমারগঞ্জ, হরিরামপুর, কুশমণ্ডি, হিলি ও বংশিহারী। জেলায় পুরসভা বলতে ২টি- বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর।
উল্লেখযোগ্য : দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্যতম লোক সংস্কৃতি খাঁ/খান সংস্কৃতি। এর গানের কথা ও বার্তালাপ হয় মূলত স্থানীয় উপভাষা অনুযায়ী। স্থানীয় স্তরে সংগঠিত হওয়া কোনও কেলেঙ্কারি বা অবৈধ কার্যকলাপকে এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
এছাড়া রয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে তৈরি নাটুয়া লোক সংস্কৃতি। পুরুলিয়াতেও একই নামে অপর এক ধরনের নাচের রীতি রয়েছে।
মোখ বা মুখোশ নাচ : একাংশ গ্রামীণ মানুষ এই মুখোশ নাচের চর্চা করে। স্থানীয়ভাবে যে সব কাঠ পাওয়া যায় তা দিয়ে মুখোশ তৈরি করা হয়। এই সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্রস্থল কুশমণ্ডি ব্লক। শিব-কালীর মতো দেব-দেবী ছাড়াও, বাঘ-বাঁদরের মনো প্রাণী ও বুড়া-বুড়ির মতো কাল্পনিক কৌতূক চরিত্রের মুখোশ তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট পোশাক-সহ পুরুষ শিল্পীরা এই মুখোশ পরে পারফর্ম করেন। নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে ড্রামার ও স্থানীয় বাঁশি শিল্পীরা সঙ্গত দেন।