মোহন প্রসাদ, দার্জিলিং: জাতির জীবন ইঁট-পাথরের ইমারত নয় যে খানিকটা ভেঙে গেলে, নতুন উপকরণে আবারও গড়ে তোলা সম্ভব…পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুবাদ নয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জীবন ভাবনার সারকথা ছিল এমনই (Deshbandhu Chittaranjan Das)। কিন্তু যে জাতির জন্য জীবনের প্রতিটি দিন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি, তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ইমারত সংরক্ষণে সেই বাঙালি জাতির উদাসীনতাই প্রতিফলিত হচ্ছে। কারণ পাহাড়ে যে বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন চিত্তরঞ্জন, অবহেলা, অবজ্ঞায় সেটির দশা এখন জীর্ণ। (Darjeeling News)
দার্জিলিংয়ের প্রাণকেন্দ্র, ম্যাল থেকে বাঁ দিক ঘেঁষে যে রাস্তা নেমে গিয়েছে, কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়ে ‘চিত্তরঞ্জন সংগ্রহালয়’। রাস্তা থেকেই সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। কোনও কালে সাদা রং করা হয়েছিল দেওয়ালে, মূল ফটকে। তার নামমাত্রই অবশিষ্ট রয়েছে। রংচটা কার্নিশ, আলসেরপ হা বেয়ে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার প্রলেপই চোখে পড়ে বেশি। সিঁড়ির উপর যে মূল ফটক, রং উঠে গিয়ে জং ধরা লোহার গ্রিল বেরিয়ে পড়েছে, যাকে জড়িয়ে রয়েছে মাকড়শার জাল।
অযত্নের ছাপ চেহারায়
কিন্তু এই অবস্থা আজকের নয়, গত কয়েক বছর ধরেই এমন জীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশবন্ধুর শেষ মুহূর্তের সাক্ষী ওই বাড়ি। ২০০৭ সালে বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী ওই বাড়িটিকে মিউজিয়ামে পরিণত করার নির্দেশ দেন। সেই মতো নামকরণ হয় ‘চিত্তরঞ্জন সংগ্রহালয়’। কিন্তু যে কোনও দিন বিপদ ঘটে যেতে পারে বুঝে, তিন বছর আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই মিউজিয়াম। এখন শুধু ফটকের বাইরে আবছা হয়ে যাওয়া ফলক এবং জীর্ণ কাঠামোটি দাঁড়িয়ে।
শুধু কি তাই! ‘চিত্তরঞ্জন সংগ্রহালয়ে’র কেয়ারটেকার গীতা শেরপা জানিয়েছেন, ২০০৮ সাল থেকে ওই বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ছাদ খারাপ হয়েছে। ফুটো হয়ে জল পড়ে। নেই শৌচাগারও। ২০১২ সালে একবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন বলে জানা যায়। সেই সময় ছ’মাসের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু তার পর আবারও, অন্ধকার নেমে আসে। দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক এস পোন্নমবালম জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের আধিকারিকরা ইতিমধ্যেই ওই বাড়ি থেকে ঘুরে গিয়েছেন। বাড়িটি সংস্কার করার চিন্তাভাবনা চলছে। শীঘ্রই সেই কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ম্যালের ঠিক পাশে, রাস্তার ধারেই
তবে শুধু সংস্কার করলেই কি হবে? জেলাশাসক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যাও রয়েছে বর্তমানে। এছাড়াও কর্মিসংখ্যার অভাব রয়েছে। মাসিক ১২৮০ টাকা বেতনের একজন মাত্র কেয়ারটেকারই রয়েছেন বাড়িটি দেখভালের জন্য। শীঘ্রই সেগুলির সমাধানসূত্র বের করা হবে।
১৯২৫ সালের ১৬ জুন ওই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশবন্ধু। শুধুমাত্র তাঁর মৃত্যুর সাক্ষী নয়, ওই বাড়ি দেশবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ওতপ্রোত ভাবে। ১৯১১ সালে অসুস্থ ভগিনী নিবেদিতাকে দেখতে প্রথম দার্জিলিং যান দেশবন্ধু। নিবেদিতে দার্জিলিং থেকে সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেননি। পুরোদস্তুর স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার পর ১৯২৫ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন দেশবন্ধু। চিকিৎসকদের পরামর্শে সেবার দার্জিলিং যান তিনিও, সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বাসন্তীদেবী।
দীর্ঘ দিন ধরে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ
দার্জিলিংয়ে ম্যালের পাশে, বন্ধুবর নীপেন্দ্রনাথ সরকারের ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান অ্যানি বেসান্ত। জুনের গোড়ার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে ওঠেন মহাত্মা গাঁধীও। তাতে আবারও রাজনীতি, সমাজনীতির চর্চায় ফিরতে শুরু করেন দেশবন্ধু। মনোরম পরিবেশ, পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটাহাঁটিতে কিছুটা সেরেও ওঠেন। কলকাতায় ফিরে জমে থাকা কাজও সেরে ফেলবেন বলে পণ নিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতায় আর ফেরা হয়নি তাঁর। ওই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।তাঁর নামেই নামকরণ হয় বাড়িটির।
১৯৫৩ সাল থেকে ওই বাড়িটি দেশবন্ধু মেমোরিয়াল সোসাইটির অধীনে রয়েছে। দেশবন্ধু মেমোরিয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হলেন রাজ্যপাল, সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন খোদ জেলাশাসক। মহকুমা দফতরের সংশ্লিষ্ট দফতর জানিয়েছে, এই বাড়ি তথা সংগ্রহালয় ছাড়াও, দার্জিলিংয়ের অন্যত্র দেশবন্ধুর আরও সম্পত্তি, বাড়ি রয়েছে। বর্তমানে সেগুলি দেখভালের দায়িত্ব সামলাচ্ছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এবং অন্য একাধিক সংগঠন। কিন্তু যে বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশবন্ধু, মহাত্মা যেখানে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিলেন, সেই বাড়ির কি এত অবহেলা প্রাপ্য, উঠছে প্রশ্ন।