কলকাতা: সন্দেশখালি নিয়ে তোলপাড় গোটা রাজ্য। সেই আবহেই রাজ্য রাজনীতিতে নতুন টানাপোড়েন, যার নেপথ্য়ে রয়েছে আধার কার্ড। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাওয়া আধার কার্ডই কাজ করছে না রাজ্যের বহু মানুষের। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থেকে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই সেই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আর সেই নিয়েই চরমে উঠেছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। (Aadhar Deactivation Allegations)

লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার অভিযোগ সামনে আসছে। সেই নিয়ে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ও। নির্বাচনের আগে এভাবে আধার বাতিল হওয়ার নেপথ্যে অন্য পরিকল্পনা রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মমতা বলেন, "নির্বাচনের আগে NRC কার্যকর করা পরিকল্পনা নয় তো BJP-র? নিশ্চয়ই এটা BJP-র পরিকল্পনা। আগে মানুষের আধার কার্ডগুলি কেড়ে নিলাম, তার পর বলব CAA দেব। আধারের নিয়ম-নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এটা। কী পরিকল্পনা? অসমের মতো বন্দিশিবির তৈরি করবেন?" (TMC vs BJP)


বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠিও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও BJP-র দাবি আধার বাতিল করা হয়নি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, "কোনও আধার বাতিল করা হয়নি। এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা খাইয়ে রাঁঁচি থেকে করিয়েছেন। উনি ভোটপাগল, ভোটের জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন।"


আরও পড়ুন: Mamata Banerjee:আধার বাতিল যাঁদের আলাদা কার্ড দেবে রাজ্য, বিশেষ পোর্টালের ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর


শুভেন্দু যদিও আধার কার্ড বাতিল হয়নি বলে দাবি করছেন, কিন্তু ঘুম উড়েছে বহু মানুষেরই। কারণ আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে বলে চিঠি হাতে পেয়েছেন তাঁরা। যে চিঠিতে লেখা রয়েছে, 'আপনার আধার নিষ্ক্রিয় করা হল'। কারণ হিসেবে লেখা রয়েছে, 'ভারতবর্ষে থাকতে গেলে যা যা নিয়ম চলা প্রয়োজন, তা পূরণ করা হয়নি'। বিতর্ক শুরু হতেই, সোমবার সকালে ড্য়ামেজ কন্ট্রোলে নামেন কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী ও বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর।


শান্তনু বলেন, "যে সমস্ত মানুষ ওপার বাংলা থেকে এসেছেন, যাঁদের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে, নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও তাঁরা যেন বিভ্রান্তির শিকার না হন, রাজনীতির শিকার না হন, তার জন্য একটা কথা বলতে চাই, "আমি আমার ইমেল আইডি দিচ্ছি এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিচ্ছি।"


কিন্তু এভাবে আধার কার্ড বাতিল নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "তফসিলি ফেডারেশনের লোকেরা জানিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মতুয়াদের উপর হচ্ছে। ওঁদের কার্ডগুলি নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে নমঃশূদ্রদের কার্ড, দরিদ্র, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষের কার্ড বাতিল হচ্ছে। প্রত্যেক জেলায় এটা হয়েছে। অথচ রাজ্য সরকার কিছু জানে না, জেলা প্রশাসন জানে না। গায়ের জোরে, লুণ্ঠনকারী সরকার কেন্দ্রের। জমিদারি কায়দায়, জমিদারের মতো আচরণ করে। জমিদাররাও এমন করত না। এরা জমিদারদের হার মানিয়ে দেবে। যার তার কার্ড কেটে দেওয়া হচ্ছে।"


এ নিয়ে CPM-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "বিহারে, অসমে ভারতীয় নাগরিককে বিদেশি বলার জন্য এই BJP-RSS কী করল? প্রথমে ডি-ভোটার করল। বলল, 'কিছু হবে না। ভোটাল তালিকা থেকে শুধু আপনার নামটা ডাউটফুল করে দিচ্ছি। আজ যেটা করছে, এই যে CAA, NRC আসবে'। ভোটের আগে বলছে, এখন কেন্দ্র এবং রাজ্য মিলে আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। এভাবেই শুরু হয়। এই ধরনের নোটিস সম্পূর্ণ বেআইনি বলেই মনে করি আমরা।"


আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে বিপাকে পড়েছেন বহু মানুষ। জামালপুর, দুর্গাপুর, কৃষ্ণগঞ্জের থেকে নাকাশিপাড়া, আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি মেলায় অথৈ জলে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযোগ, সম্প্রতি নাকাশিপাড়া ব্লকের বেথুয়াডহরির কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামে প্রায় ২০ জনের বাড়িতে পোস্ট অফিস মারফত আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি এসেছে। বেথুয়াডহরির বাসিন্দা বাদল মণ্ডল বলেন, "আমার আধার কার্ড এসেছে দিন ১৫ হল। এখন দেখছি, কার্ড বাতিল হয়ে গিয়েছে। আমাদের ব্যাঙ্কের বই নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে আমরা কী করব? খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি।"

নাকাশিপাড়ার BDO জানিয়েছেন, তাঁর কাছে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। সরকারি কোনও নির্দেশিকাও আসেনি। কিন্তু কৃষ্ণগঞ্জ, নাকাশিপাড়ার মতোই আচমকা আধার নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি পেয়ে চমকে উঠেছেন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। সেখানে ৩০টি পরিবারের কাছে আধার কার্ড বাতিলের চিঠি পৌঁছেছে। বনগাঁর বাসিন্দা বিথীকা মণ্ডল বলেন, "আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রেশন বন্ধ, গ্যাস তুলতে পারছি না। সরকারি পরিষেবা পাচ্ছি না আমরা।"

পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসায় আধার কার্ড বিভ্রাটের জেরে বিপাকে কলেজ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎও। কাঁকসা বনকাটি পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা আশা বিশ্বাস বীরভূমের ইলামবাজারের কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া। কয়েক মাস পরেই পরীক্ষা। কয়েকদিন আগে তারই ফর্ম ফিলাপ করতে যান আশা। সেখানে গিয়ে আধার কার্ডের নম্বর দিয়ে পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়েই বুঝতে পারেন, তাঁর আধার কার্ড বাতিল হয়েছে।
শনিবার আধার কার্ড বাতিলের একটি চিঠিও হাতে পেয়েছেন তিনি।

আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি এসেছে হুগলিতেও। হুগলির কোদালিয়া ১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের রবীন্দ্রনগর, সুকান্তনগর, কৃষ্ণপুর এলাকায় আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি এসেছে অনেকের কাছেই। মোগরা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সুকান্ত পল্লি, মাঠাপারা, ভেরিকুটি, নতুন গ্রাম,জয়পুর,পাম্প কলোনি এলাকার ৭০ জনের কাছে এই চিঠি এসে পৌঁছেছে।


সোমবার, জামালপুরের যুথাহাটিতে আধার কার্ড বাতিল হওয়া পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন স্থানীয় বিধায়ক অলোককুমার মাঝি। পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি। এখানকার, কয়েকজন গ্রামবাসীর কাছে চিঠি আসে আধার নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। লোকসভা ভোটের মুখে ফের আধার বাতিলের অভিযোগ ওঠায়, রাজ্য সরকারের তরফে নতুন পোর্টাল চালু করার কথা রবিবারই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন। কথা বলা হচ্ছে UIDAI-এর সদর দফতরেও।

যদিও আধার কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, কোনও আধার নম্বর বাতিল করা হয়নি। আধার তথ্য আপডেট করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল ইউআইডিএআই। কোনও অভিযোগ থাকলে ইউআইডিএআই-এর পোর্টালে জানান।