অনির্বাণ বিশ্বাস, ব্রতদীপ ভট্টাচার্য ও রুমা পাল, কলকাতা : ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে ঝাঁঝাঁল আক্রমণ শানালেও, সিপিএম সম্পর্কে কার্যত নরম অবস্থান নিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। আর কংগ্রেসের নাম তিনি মুখেই আনলেন না। যা দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এটা কি ঘুরিয়ে জোট-বার্তা ? এর ফলে কি এরাজ্য়ে সিপিএম-কংগ্রেস অস্বস্তিতে পড়বে ? এনিয়ে মুখ খুলেছে দুই বিরোধী দলই।


অন্য়ান্য়বারের মত এবারও, এই মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় লোকসভা ভোটের রণকৌশল ঠিক করে দিলেন ! একাধিক ইস্য়ুতে বিজেপিকে নিশানা করলেন ! মোদি সরকারকে ক্ষমতাচ্য়ুত করার ডাক দিলেন ! কিন্তু, অন্য়ান্য় বারের মতো, এবার তৃণমূল নেত্রীর ঝাঁঝাঁল আক্রমণের নিশানায় রইল না সিপিএম ও কংগ্রেস। যা বিজেপি-বিরোধী মহাজোট তৈরির চেষ্টার আবহে, অত্য়ন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।


এদিন পঞ্চায়েতে হিংসার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিপিএমের নাম করেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ! বলেন, 'সিপিএমের বন্ধুরা, মমতা ব্যানার্জি চিরকালই আপনাদের অ্যালার্জি। ২০০৩-এ যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল, কত মানুষ খুন হয়েছিল ? ৮৯ জন। ২০০৮-এ খুন হয়েছিল, শুধু নির্বাচনের দিন ৩৯ জন।'


এনিয়ে অবশ্য জবাব দিতে ছাড়েনি সিপিএম। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, 'বুদ্ধবাবুর নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতা মুখ্যমন্ত্রীর নেই। কিন্তু, ২০০৮ সালেও বামফ্রন্ট আমলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ আসন তৃণমূল পেয়েছে। তার জন্য লোককে কোনও দিন হারাতে হয়নি। তার জন্য হেরে পঞ্চায়েত জিতবার ব্যবস্থা করতে হয়নি।'


আর একবার তৃণমূলনেত্রীর মুখে সিপিএমের নাম শোনা যায়, পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন প্রসঙ্গে। মমতা বলেন, 'আমাদের পঞ্চায়েতগুলো সিপিএমের কায়দায় নয়। মা-মাটি-মানুষের কায়দায় ভাল করে কাজ করবে।' তবে এর বাইরে ২১ জুলাইয়ের সভা থেকে সিপিএমকে আর কোনও কড়া আক্রমণের পথে যাননি তৃণমূলনেত্রী !


আর কংগ্রেসের নাম তো তিনি একবারের জন্য় মুখেও আনেননি ! কিন্তু, গতবারও ২১ জুলাইয়ের সভা থেকে কংগ্রেসকে কড়া ভাষায় নিশানা করেছিলেন মমতা। কয়েকদিন আগে অবধিও ছবিটা ছিল এরকমই ! মাত্র ন'দিন আগে, ভোট-হিংসা প্রসঙ্গে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপিকে একসারিতে ফেলেই আক্রমণ করেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ! বলেছিলেন, 'আমি দুঃখিত যে, রাম, বাম শাম প্লাস আরেকজন জোট বেঁধে মহাঘোঁট বেঁধেছিল। তাদেরই এসব প্ল্য়ানিং ছিল গন্ডগোল করার।'

এরপরই মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুতে বৈঠকে বসে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি। যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমঞ্চে দেখা যায়-সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরিদের। বৈঠকে সনিয়া এবং রাহুলের মাঝে বসেন তৃণমূলনেত্রী। এই বৈঠক থেকেই আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি-বিরোধী মহাজোট INDIA। এই প্রেক্ষাপটে একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে, সিপিএম-কংগ্রেস সম্পর্কে নীরব থেকে, মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় যেভাবে লাগাতার বিজেপিকে আক্রমণ করে গেলেন, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এটা কি ঘুরিয়ে সিপিএম-কংগ্রেসের উদ্দেশে তৃণমূলনেত্রীর জোটবার্তা ? নাকি রাজ্য়ের সিপিএম এবং প্রদেশ কংগ্রেসকে কার্যত উপেক্ষা ?


তৃণমূলনেত্রীর এই অবস্থানের পর এ রাজ্য়ে কি সিপিএম-কংগ্রেস অস্বস্তি আরও বাড়ল ? এপ্রসঙ্গে সুজন চক্রবর্তী বলছেন, 'বলেছেন তো। তা সত্ত্বেও তো বলে গেছেন। ২০০৩, ২০০৮, পঞ্চায়েত যাবতীয় গোলযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি...সিপিএম...উনি বলেছেন। আর বেশি বললে হাস্যকর হয়ে যাচ্ছেন নিজের কাছেই। উনি হাসি চাপতে পারছেন না। আর বেশি বলতে পারেননি। বিজেপির বিরুদ্ধে...কংগ্রেস-সিপিএম এই দলগুলো কয়েক মাস ধরে লড়াই করে যাচ্ছে। উনি ছিলেন না। উনি তখন রাষ্ট্রপতি-উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে ছিলেন।'


তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এবার তৃণমূলনেত্রী আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ৪২-এ ৪২ আসন জেতার দাবিও করেননি। এখন মূল প্রশ্ন হল, বাংলায় কি আদৌ তৃণমূল-কংগ্রেস-সিপিএম জোট সম্ভব ? এপ্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলছেন, 'মমতা ব্যানার্জির মনে হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগকে গ্রাহ্য করে না। কংগ্রেস সবসময় সঠিক কথা বলে। সেটা মানুষ গ্রাহ্য করে বলেই সেই কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জির কিছু বলা সমীচিন হবে না। সেটা বুঝেছেন। তাই হয়তো বলতে চাইছে না। কিন্তু আমরা আবার বলছি, বাংলায় সন্ত্রাস-অত্যাচার চলছে। ' 


এদিকে সিপিএম-কংগ্রেস নিয়ে তৃণমূলনেত্রী 'নীরব' থাকায়, কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, 'বেঙ্গালুরুতে তো সেটেলড হয়েছে। বাংলার লোকরা দেখুন। আর বাম-কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীরাও দেখুন, কাদের জন্য তাঁরা লড়াই করেছেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচুর বাম-কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক প্রাণ দিয়েছেন। ঘরছাড়া হয়েছেন। এখনও জেলে অনেকে আছেন। অনেকের পরিবার অসহায় অবস্থায়, নিঃস্ব অবস্থায় তাঁরা দিন কাটাচ্ছেন। আমি বাম-কংগ্রেসের বুথ স্তরের লড়াই করা সমস্ত তৃণমূল-বিরোধী জনতাকে বলব, বিজেপির সঙ্গে আসুন। একসঙ্গে এই অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করি।'


তবে এসবের মধ্য়ে লাখ টাকার প্রশ্ন এখনও একটাই। শেষ অবধি লোকসভা ভোটে, এরাজ্য়ে তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেসের জোট কি সম্ভব হবে ?