অরিন্দম সেন, আলিপুরদুয়ার: সেজে উঠছে রাজ্যে প্রথম বই-গ্রাম গড়ার প্রস্তুতি। তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট গ্রন্থাগার। সুরের ছন্দে, তুলির টানে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে ফুটে উঠছে বই সংক্রান্ত বার্তা। আদিবাসী জনজাতি অধ্যুসিত এই গ্রামকে 'বই-গ্রামে' পরিণত করার উদ্যোগে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের পর্যটনে "বই-গ্রাম", নতুন মাত্রা দেবে বলেই আশাবাদী সংগঠক থেকে প্রশাসন। 


আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের অন্তর্গত জনজাতি অধ্যুষিত রাজাভাতখাওয়ার পানিঝোড়া গ্রামেই তৈরি হচ্ছে এই 'বইগ্রাম' । বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে এই গ্রাম আজ বইপ্রেমীদের কাছে ক্রমশ চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। জানা গিয়েছে, "আপনকথা" নামক একটি সংগঠন এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন এই গ্রামটিকেই বেছে নিয়েছে বইগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। এর আগে মহারাষ্ট্রের ভিলার ও কেরলের পেরুকালেম ছাড়া এমন উদ্যোগ বিশেষ দেখা যায়নি ৷ 


প্রশাসনিক আধিকারিক, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকরা উপস্থিত থেকে তদারকি করছেন বই-গ্রামের প্রস্তুতির। চলছে জোর কদমে গ্রাম সাজানোর কাজ। অগাষ্টের তৃতীয় সপ্তাহেই এর উন্মোচন হতে পারে বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা। 


আলিপুরদুয়ার শহর থেকে রাজাভাতখাওয়ার মাঝে প্রায় ১২ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই পানিঝোড়া গ্রামটি। ছোট্ট এই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৩২০  জন ৷ পরিবার রয়েছে মাত্র ৭২টি ৷ ছাত্রছাত্রী রয়েছে মোট ৭০-৮০ জন। গ্রামের মধ্যেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যার পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৪২ জন। আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই গ্রামের মানুষের রোজগার অনেকটাই নির্ভর জঙ্গল আর দিন-মজুরিতে।  




কেন এমন ভাবনা? 


"আপন কথা"-র সম্পাদক পার্থ সাহা বলেন, মডেল বই গ্রাম গড়ে তোলা হবে। আমরা চাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক নতুন প্রজন্ম। কারণ, জনজাতি অধ্যুষিত এই গ্রামের পড়ুয়ারা বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। পড়ার বই পেলেও জ্ঞান অর্জনের জন্য অন্যান্য বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোই প্রথম লক্ষ্য। পাশাপাশি গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষকে স্বাক্ষর করে তোলার কাজ যেমন চলবে তেমনি নাটক, নাচ, গানের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সংষ্কৃতির প্রশিক্ষণ ও পরিবেশনেরও উদ্যোগ নেওয়াও হচ্ছে। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের ইতিহাস জানতে বইপ্রেমী পর্যটকের সম্ভাবনাও প্রবল হবে। 


কীভাবে হচ্ছে বই গ্রাম তৈরির কাজ? 


ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ ১০টি গ্রন্থাগার তৈরী করা হচ্ছে। যেগুলো গ্রামের নির্দিষ্ট ১০টি বাড়িতে থাকবে। যেগুলো দেখভাল করবে খুদে পড়ুয়ারাই। পাশাপাশি একটি প্রধান উন্মুক্ত গ্রন্থাগার থাকছে। জানা যায়, আপাতত গ্রামের প্রাথমিক স্কুলেই তার ব্যবস্থা হলেও পরবর্তীতে নিজস্ব ভবন হবে গ্রন্থাগারের। এছাড়া গোটা গ্রামকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে বই ও সামাজিক বার্তামূলক চিত্রকলায়। যাতে আকৃষ্ট হয় শিশু পড়ুয়ারা। সুরের ছন্দে, তুলির টানে ফুটে উঠছে বই ও সামাজিক বার্তা।  জানা যায়, গ্রামের একমাত্র বাস-স্ট্যান্ডকেও একইভাবে আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তোলার পর বহিরাগতদের স্বাগত জানানোর জন্য গ্রামের প্রবেশ মুখেই তৈরী হবে তোরণ। 


কী বলছে এই গ্রামের মানুষরা? 


গ্রামের এক মহিলা পারুল মিঞ্জ বলেন, 'আমরা খুবই খুশি হয়েছি এই উদ্যোগে'। তার কথায়, এর আগে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার আলোকবর্তিকার সাফল্য দেখে তারাও উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষায় আলোকিত করতে বদ্ধপরিকর তাঁরাও। কারণ, শিশুদের মোবাইল-টিভির জগৎ ছেড়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বলে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। তা দেখেই তারা খুশি আপ্লুত। ফলে, গ্রাম সাজাতে তারাও এগিয়ে এসে হাত দিয়েছেন কর্মকাণ্ডে। বাড়ির দেওয়ালকে সাজিয়ে তুলতেও তারাও সায় দিয়েছেন সানন্দে। তারাও চাইছেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক তাদের আগামী প্রজন্ম। বিকাশ ঘটুক তাদের প্রতিভার। তাঁর কথায়, এই উদ্যোগে পানিঝোড়া গ্রামের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। 




কতটা সম্ভাবনা পর্যটনের? 


উদ্যোক্তাসূত্রে দাবী, স্থানীয় বক্সাদূর্গ, জয়ন্তি, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, ইন্দো-ভুটান ইতিহাস, জনজাতির ইতিবৃত্তসহ উত্তরবঙ্গের ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হবে গ্রন্থাগারের বইগুলিতে। থাকবে ডুয়ার্সের প্রকৃতি, প্রাণীসম্পদ। ফলে রাজাভাতখাওয়া, জয়ন্তি-বক্সায় জঙ্গল-পাহাড়, শকুন প্রজনন কেন্দ্রের পাশাপাশি এই বইগ্রামও আকৃষ্ট করবে পর্যটকদের। পাশাপাশি গবেষণার কাজই হোক বা চর্চা সব বিষয়েই বইপ্রেমী পর্যটকদের এই প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে আকৃষ্ট করবে বলেই আশা উদ্যোক্তাদের। 



'বই গ্রাম' নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় শিক্ষকমহল থেকে শিক্ষাবিদরাও  


স্থানীয় পানিঝোড়া বিএফপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সামিল হয়েছেন এই বইগ্রাম গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে। সহ-শিক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের পড়ুয়াদের কাছে প্রয়োজনীয় বই বা সহায়িকা কেনাও অত্যন্ত জটিল বিষয়। কারণ এখান থেকে শহরের দূরত্ব ১২ কিমি। ফলে তাদের কাছে সেই অভাব মিটে যাবে। অপর সহ-শিক্ষক রণজিৎ বর্মন বলেন, পড়াশুনার পরিবেশ ছিল না।  তার কথায়, এটা উৎসবের মতো বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। অভিভাবক থেকে জনপ্রতিনিধি সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছে, সহযোগিতা করছেন। 


লেখক প্রমোদ নাথ বলেন, সম্ভবত ভারতবর্ষে তৃতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রথম এই বই-গ্রামের উদ্যোগ। যা অত্যন্ত ভালো লাগারই বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি এখনও বই যেমন অজানাকে জানার একটা প্রধান মাধ্যম তেমনি একটা বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে সক্ষম। ফলে এই গ্রামের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে বলেই বিশ্বাস রাখি। 


আলিপুরদুয়ার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) আশানূল করিম নিজে উপস্থিত থেকে বই-গ্রামের কর্মকান্ডে সামিল হয়েছেন। তার কথায়, উদ্যোগকে সাধুবাদ। এই উদ্যোগ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। মানুষ আবারও বই-প্রেমে সামিল হবে। অনুপ্রাণিত হবে। গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে সাক্ষর করে তুলতেও সাহায্য করবে। পাশাপাশি ডুয়ার্সের এই প্রাকৃতিক বৈচিত্রের পর্যটনে বই-গ্রাম ঢুকে পড়বে বলেই আশাবাদী আলিপুরদুয়ার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক)।


 


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে