কলকাতা: লোকসভা নির্বাচনের আগে শিল্পের সহায়ক রাজ্য বাজেট। রাজ্য বিধানসভায় বাজেট পেশ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সেখানে একাধিক প্রস্তাব আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে, লিজহোল্ড জমিকে ফ্রিহোল্ড জমিতে পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি চারটি নতুন সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার ইউনিট স্থাপনের কথাও জানিয়েছে রাজ্য। (West Bengal Budget)


বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বাজেট পেশ করেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনি জানান লিজহোল্ড জমিকে ফ্রিহোল্ড জমিতে পরিবর্তন করতে ইতিমধ্যেই নীতি প্রণয়ন করেছে রাজ্য সরকার। এই নীতি রাজ্য সরকারের সমস্ত বিভাগ, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, পৌরসভা এবং পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। জমি প্রাপকদের সুবিধার্থে এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এ নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালুর কথাও জানিয়েছে রাজ্য। (Mamata Banerjee)


বাজেটে বলা হয়েছে, স্যান্ড মাইনিং পলিসি ২০২১ এবং স্যান্ট মাইনিং রুলসের আওতায় WBMDTMC স্যান্ড মাইন ব্লকগুলির নিলামের জন্য MDO প্যানেল থেকে নথিভুক্ত মাইন ডেভলপার অ্যান্ড অপারেটর নির্বাচনের জন্য সাতটি টেন্ডার ডাকা হয়েছে। যে সমস্ত খনির কাজ ২০২৪ সালের মার্চ মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, সেগুলিকে এর আওতায় আনা হবে। গৌরাঙ্গডি এবিসি কোল মাইনের জন্য সংশোধিত মাইনিং-এর পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিধিবদ্ধ ছাড় পাওয়ার পর (EC, FC) মাইন প্ল্যান অনুযায়ী, গৌরাঙ্গডি এবিসি কোল মাইন থেকে কয়লা উৎপাদনের কাজ ২০২৪ থেকে শুরু করা যাবে বলে আশাবাদী রাজ্য।


রায়ত জমির জন্য নতুন খনন নীতি গ্রহণ করেছে রাজ্য। এর ফলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলার মানুষ যাঁরা প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহণ এবং অন্যান্য খনিজ উত্তোলনের আনুষঙ্গিক কাজে যুক্ত, তাঁদের বিজ্ঞানসম্মত ও সুস্থায়ী জীবিকার পথ সুনিশ্চিত হয়েছে। WBMDTCL ৮৭টি ‘অভিপ্রায় পত্র’ (LOI) প্রকাশ করেছে। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে খনিগুলির কাজ চালু হবে বলে আশা করছে রাজ্য। নদীগুলির স্বাভাবিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে বর্ষায় ড্রেজিং চলছে। নদীগর্ভে জমে থাকা পলি তোলা হচ্ছে। এর জন্য ভলিউম শেয়ারিং মডেল মেনে চলা হচ্ছে, ফলে খরচ বহন করতে হচ্ছে না সরকারকে। বরং খননকৃত বস্তুসমূহের পুরোটাই রাজ্য ব্যবসায়িক ভাবে ব্যবহার করবে।


আরও পড়ুন: West Bengal Budget: সুদ-পেনাল্টি থেকে মুক্ত হোটেল ব্যবসায়ীরা, গাড়িতেও করছাড়, দলিলে স্ট্যাম্প ডিউটি বেঁধে দিল রাজ্য


WBIDC, WBIIDC বিভিন্ন শিল্প পার্কে বিভিন্ন ইন্টাস্ট্রিয়াল ইউনিটকে জমি বরাদ্দ করছে। WBIIDC-র অধীনস্থ সমস্ত ইন্টাস্ট্রিয়াল পার্কের ডিজিটাল সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। কাজ মূল্যায়নের জন্য ইউনিট লেভেল ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন সফ্টওয়্যারের কাজ সাফল্যের সঙ্গে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য।


২০২৩ সালের বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেসনের সপ্তম অধিবেশনের উল্লেখ করে রাজ্য জানিয়েছে, ইউরোপ, ব্রিটেন, সিআইএস সার্ক, পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, আসিয়ান, ল্যাক, মধ্য এবং পূর্ব এশিয়া-সহ অন্যত্র থেকে ৪০০ জন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি তাতে যোগ দেন। ব্যবসায়িক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ওয়েস্ট বেঙ্গল এক্সপোর্ট প্রোমোশন পলিশি ২০২৩ গৃহীত হয়েছে। রাজ্যকে বাণিজ্যের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে গ্রিন লজিস্টিকের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী রাজ্য।পরবর্তী পাঁচ বছর এটি কার্যকর থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ের দুই পাশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবসায়িক করিডর গড়ে তুলতে, অর্থনৈতিক অঞ্চল বা পরিসর শনাক্তকরণ এবং স্থানীয় ব্যবসার উন্নয়নে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইকনমিক করিডর পলিসি ২০২৩ গৃহীত হয়েছে।


ওয়েস্ট বেঙ্গল নিউ অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোমশন পলিসি ২০২৩ গৃহীত হয়েছে, যার আওতায় বড় শিল্পপতিদের নবায়ণযোগ্য শক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে। শক্তির জোগানে অপ্রতুলতার মোকাবিলায়ও উৎসাহ প্রদান করা হবে। উত্তরবঙ্গে অব্যবহৃত চা বাগানগুলিতে পরিবেশবান্ধব পর্যটন প্রসারের লক্ষ্যে দ্য টি ট্যুরিজম অ্যান্ড অ্যালায়েড বিজনেস পলিসি ২০১৯ গৃহীত হয়েছে। এতে ৩১৬.৪৫ কোটি বিনিয়োগের সম্ভাবনা-সহ চারটি চা বাগানে পাঁচটি প্রকল্পে অনুমোদন মিলেছে। উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ৪টি WBIDC-র অধীনে, ১০টি WBIIDC-র অধীনে চিহ্নিত করা হয়েছে।


ব্যবসা সহজ করে তুলতে রেডিস্ট্রার অফ ফার্মস, সোসাইটিজ এবং নন ট্রেডিং কর্পোরেশন নতুন ওয়েব পোর্টালের সূচনা করেছে। সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে CNG, PNG প্রাকৃতিক গ্যাসকে ঘরোয়া ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বণ্টনের কাজ দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে। বেঙ্গল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড কলকাতা এবং আশাপাশে ১০টি CNG স্টেশন পরিচালনা করছে এবং KMDA, HIDCO ৭৮ কিসোমিটার স্ট্রিল পাইপলাইন, ১৫৫ কিলোমিটার MVPF পাইপলাইন স্থাপনের কাজ সম্পূর্ণ করেছে, যা পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের গ্যাস পাইপলাইন মানচিত্রে চিহ্নিত করেছে। পাইপলাইন স্থাপনের কাজ সম্পূর্ণ হলে রাজ্যে LPG, CNG গ্যাসের জ্বালানি সস্তায় পাওয়া যাবে বলে দাবি রাজ্যের।


চন্দ্রিমা জানিয়েছেন, গত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, আর্থিক এবং শিল্পক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। শিল্প এবং বাণিজ্যক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার Urban Land Ceiling আইন প্রত্যাহার করে। একাধিক রাজ্যও সেই পথে হাঁটে। পশ্চিমবঙ্গেও এবার আইনটি পুনর্বিবেচনা করে দেখা হবে। পাশাপাশি, West Bengal Land Reforms আইনের ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ধারাগুলি পুনর্বিবেচনা করে দেখবে রাজ্য।


রাজ্যে চারটি নতুন সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার ইউনিট স্থাপনের ঘোষণা হয়েছে বাজেটে। বলা হয়েছে, গৃহ এবং শিল্পক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান দিতে সাঁওতালডিহি, বক্রেশ্বর এবং দুর্গাপুরে আগামী চার বছরের মধ্যে, ২ হাজার ৯২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এই চারটি থার্মাল পাওয়ার ইউনিট গড়ে তোলা হবে, তাতে খরচ পড়বে ২৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। PPP মডেলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের সূচনার জন্য। রাজ্য সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে এদিন।


এদিন ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড ইন্টারেস্ট সাবভেনশন স্কিমের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। রাজ্য জানিয়েছে, এই প্রকল্পের অধীনে কোনও রকম কোলাটেরাল ছাড়াই নামমাত্র ৪ শতাংশ সুদে ১০০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। বাকি সুদের ভার ইন্টারেস্ট সাভভেনশন হিসেবে রাজ্য বহন করবে। এই খাতে বার্ষিক ২৫০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামী ১০ বছরে এতে ১০ লক্ষ তরুণ ব্যবসায়ী উপকৃত হবেন বলে দাবি রাজ্যের।


কারিগরদের জন্য West Bengal Artisans Financial Benefit Scheme-এর ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে কারিগররা এককালীন ১৫০০০ টাকা এবং শিল্প সমবায় সমতি ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পাবেন যন্ত্রপাতি কিনতে, শেডের নির্মাণ, মেরামতি এবং মার্কেটিংয়ের জন্য। এই প্রকল্পে বার্ষিক ২ লক্ষ কারিগরকে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০০ কোটি বরাদ্দ করেছে রাজ্য।


কারিগর এবং তাঁতশিল্পীদের জন্য Artisan & Weavers (Death Benefit) Scheme-এর আওতায় রাজ্য ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সিদে মৃত্যুতে পরিবারকে এককালীন ২ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। এই খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। হ্যান্ডলুম এবং খাদি শিল্পে যুক্ত কর্মীদের জন্য West Bengal Handloom & Khadi Weavers Financial Benefit Scheme 2024-এর আওতায় ৫০০ Primary Weaver Cooperative Societies, ২০০ খাদি সোসাইটি এবং শিল্পীদের অ্যাকাউন্টগুলি এককালীন সেটলমেন্ট হবে, কার্যকরি মূলধনে সহায়তা এবং ভর্তুকিযুক্ত সুতোর জোগানের কথাও জানিয়েছে রাজ্য।