২০২১ এ হাইভোল্টেজ বিধানসভা নির্বাচনে জিতে, টানা তৃতীয়বার রাজ্যে ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। এরপর বছর শেষে কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে বিরাট জয় পায় তৃণমূল। এই জয়ের গন্ধ মেখে ২০২২ এর পুরভোটকে পাখির চোখ করে নতুন বছরে পা রাখে ঘাস-ফুল শিবির। নিয়োগ দুর্নীতিতে একের পর এক নেতার গ্রেফতারি থেকে আদালতের একের পর এক ঐতিহাসিক রায়, পুরভোটে ঝোড়ো ইনিংস খেলে পঞ্চায়েতের দিকে এগিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি নানা ঘটনায় ভরে রইল এই বছরটা। সবার উপরে নজর কাড়লেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যায্যদের চাকরি থেকে বহিষ্কার থেকে ন্যায্য অধিকারে লড়া মানুষগুলির পাশে দাঁড়িয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন বিচারপতি। 


 তৃতীয় ঢেউ 
বছরের শুরুতেই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় করোনা।  পুরভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েও পিছিয়ে যায় তারিখ। অন্যদিকে পুরভোটকে সামনে রেখে একের পর এক সভা চলতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে করোনাভাইরাস ! তৃতীয় ঢেউ ঢুকে পড়ে প্রায় প্রতি ঘরে। 


 ডায়মন্ড হারবার মডেল 
জানুয়ারিতে করোনা সংক্রমণ তুঙ্গে পৌঁছায়। এই পরিস্থিতিতে করোনার বাড়বাড়ন্ত রুখতে সেই সময় ২ মাস ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক প্রচার বন্ধ রাখার পক্ষে সওয়াল করেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় জারি হয় একগুচ্ছ বিধি নিষেধ। সংক্রমণ রুখতে এই কড়াকড়ি। সেই সঙ্গে রান্ডম টেস্টিং। অভিষেকের এই মডেল ম্যাজিকের মতো কাজ করে। অভিষেকের মডেল নিয়ে অন্তর্তৃণমূলীয় তর্জা টক অফ দ্য পলিটিক্যাল করিডোর হয়ে যায়। সেই সময় মাঠে নেমে তৃণমূলীদের কড়া ভোকাল টনিক দেন নেত্রী। দেন দলে একসঙ্গে থাকার বার্তা । 


১০৮ আসনে পুরভোট
ফেব্রুয়ারির শেষে রাজ্যের ১০৮ আসনে পুরভোট গ্রহণ হয়। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে রাজ্যের একাধিক আসনে ভোট গ্রহণ হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি । রবিবারের ভোটগ্রহণ পর্বের পর ২ রা মার্চ ভোটের ফলাফল গণনা হয়। আগেই কর্পোরেশনের ভোটে ঘাসফুল সুনামি দেখা গিয়েছিল বাংলায়।  জেলায় জেলায় পুরভোটে ১০৮ আসনে শেষমেষ দাপট ধরে রাখে তৃণমূলই। 


২ মার্চ হয় ফল ঘোষণা। পুরভোটে ফের তৃণমূলের জয়জয়কার। ১০৮ পুরসভার মধ্যে, তৃণমূল পায় ১০২। নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভা দখল করে বামেরা। দার্জিলিং পুরসভায় জয়ী হয় নতুন দল, হামরো পার্টি। ১০৮ পুরসভার মধ্যে ৩৩টাই হয় বিরোধীশূন্য।


 উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়
২০২১-এর বিধানসভা ভোটের সাড়ে ১১ মাস পরে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে April এ জেতে তৃণমূলই। তৃতীয় স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে সিপিএম। তাদের প্রাপ্ত ভোট এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়ে। উল্টোদিকে ১১ মাসের মধ্যে তৃতীয় স্থানে চলে যায় বিজেপি। বালিগঞ্জে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আসানসোলেও বিরাট ব্যবধানে জয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা।  


অর্জুনের ঘরওয়াপসি
পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিজেপিতে ধাক্কা দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে, তৃণমূলে ফেরেন অর্জুন সিংহ। মে মাসে দল বদলের পর অর্জুন সিংহ বলেন, যে ঘরের ছেলে ছিলাম, সেই ঘরে ফিরে এসেছি। পদ্মসঙ্গ ত্যাগ করে বলেন, ' মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন থেকে দল গঠন করেছিলেন, তার আগে থেকে আমি ওনার সঙ্গে আমি কাজ করেছি। এটা আমার জন্য কোনও নতুন ব্যাপার নয়।' 


বিজেপির বিকাশ ভবন অভিযান
এরই মধ্যে SSC-র নিয়োগে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি!সল্টলেকে বিজেপির বিকাশ ভবন অভিযান ঘিরে ধুন্ধুমার বেঁধে যায়। দফায় দফায় ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে জল কামান চালায় পুলিশ। রাস্তায় বসে পড়েন সুকান্ত মজুমদার। এরপর থেকেই এসএসসি দুর্নীতি কাণ্ডে একের পর এক বিক্ষোভ শুরু হয়। 


এরই মধ্যে গরুপাচার মামলার তদন্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় এজেন্সি । অনুব্রত মণ্ডলকে বারবার ডেকে পাঠিয়ে টিকিটি পাচ্ছিলেন সিবিআই। 


অভিষেকের স্বস্তি
এর মধ্যে মে মাসের মাঝামাঝি, কয়লা পাচার মামলায় সুপ্রিম কোর্টে কিছুটা স্বস্তি পান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী রুজিরা। ইডির বারবার দিল্লিতে তলবের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছিলেন তাঁরা। 


সৌরভের বাড়িতে অমিত শাহ 
বিধানসভাভোটের পর হারের সিলসিলা চলছিলই। দীর্ঘদিন পর মে মাসে বঙ্গে আসেন অমিত শাহ। সবাইকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেহালার বাড়িতে যান অমিত শাহ। মহারাজের বাড়িতে শাহী ভোজও সারেন। 


DA, SSC নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বড় রায় : পরেশ অধিকারীর মেয়েকে চাকরি থেকে বরখাস্ত


মে মাস ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে ঘটনাবহুল। একইদিনে তিন ক্ষেত্রে আদালতে ধাক্কায় খায় রাজ্য।  DA, SSC নিয়োগ দুর্নীতি এই দুই বিষয় ফোকাসে চলে আসে। ডিএ মামলায় তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে বকেয়া মেটাতে নির্দেশ দেয় আদালত। SSC মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে রক্ষাকবচ দেয় না ডিভিশন বেঞ্চ। আর শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়েকে বরখাস্ত করে, ৪১ মাসের বেতন ফেরাতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ।


এই সময় থেকেই ভোট পরবর্তী হিংসা মামলা, নিয়োগ দুর্নীতি মামলা, গরুপাচারের তদন্তে একের পর এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ করতে শুরু করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। সেই সঙ্গে এসএসসির চাকরিপ্রার্থীরা অবস্থান মঞ্চে টানা আন্দোলন শুরু করে। 


পার্থ - অর্পিতার গ্রেফতারি 
২৩ জুলাই মাসে SSC দুর্নীতি কাণ্ডে ED-র হাতে গ্রেফতার হন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।  দিনভর তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায় ED। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে দাবি, তদন্তে সহযোগিতা করছিলেন না তিনি। পরদিন সকালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। 


 ওই সময়েই একটানা উনিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর,তৎকালীন শিল্প, পরিষদীয় ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে ইডি। অন্যদিকে, একুশ কোটির বেশি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়-ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কেও। ট্রাঙ্ক ভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয় অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড়। ২৭ কোটি ৯০লক্ষ টাকা  এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট উদ্ধার করা  রে  এরপর তার অপর ফ্ল্যাটথেকে। টালিগঞ্জে কোটি টাকা উদ্ধার হয়। 


অনুব্রতর গ্রেফতারি 
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পর তৃণমূলের আরও এক হেভিওয়েট নেতা অনুব্রত মণ্ডল অগাস্ট মাসে পড়ে  এজেন্সির জালে। গরুপাচার মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। সিবিআই সূত্রে খবর, ফৌজদারি দণ্ডবিধির 41A ধারায় গরুপাচার মামলায় সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতিকে। কিন্তু সে সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠারেঠোরে কেষ্টর পক্ষেই কথা বলেন। ‘যদি কেউ অন্যায় করে থাকে, বিচারে প্রমাণিত হলে তার দায়িত্ব সে নিজে নেবে। সরকার ও দল এর সাথে কোনোভাবে জড়িত থাকবে না। কিন্তু অযথা আমার গায়ে কালি ছেটানোর চেষ্টা করলে, আলকাতরা কিন্তু আমার হাতেও আছে।’


বিজেপির নবান্ন অভিযান 
বিজেপির নবান্ন অভিযান ঘিরে বাংলার  একাধিক জায়গা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। তখন লালবাজারের চৌহদ্দির মধ্যেই আটকে থাকেন শুভেন্দু অধিকারী। সাঁতরাগাছি যাওয়ার পথে, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর মুখেই পুলিশ আটকে দেয় শুভেন্দু অধিকারী, লকেট চট্টোপাধ্যায় ও রাহুল সিনহাকে। নবান্ন অভিযানে অংশ নিয়ে মাথা ফাটে কলকাতা পুরসভার বিজেপি কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিতের। পুলিশের মারে আহত হন বিজেপি নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। রক্ত ঝরে পুলিশেরও।


মানিক ভট্টাচার্য গ্রেফতার
এরপর অক্টোবরে নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করে ইডি। বয়ানে অসঙ্গতি এবং জেরায় অসহযোগিতার অভিযোগ এনে পলাশিপাড়ার বিধায়ককে গ্রেফতার করা হয়। ইডির তরফে  মানিককে সিজিও কমপ্লেক্সে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আদালতে ইডি-র দাবি, টাকার বিনিময়ে চাকরি-বিক্রির অন্যতম মূল মাথা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি। ইডি-র দাবি, ২০১১-র পর মানিকের আমলে ৫৮ হাজারেরও বেশি নিয়োগ হয়েছে। 


টেট আন্দোলন ও পুলিশের কামড় 
অক্টোবরে ২০১৪ সালের টেট (Primary TET ) চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে কুরুক্ষেত্রের চেহারা নেয় সল্টলেকের করুণাময়ী মোড়। ৮৫ ঘণ্টার মাথায় মধ্যরাতে জোর করে আন্দোলনকারীদের তুলে দেয় পুলিশ। অনশনকারী টেট উত্তীর্ণ প্রার্থীদের অভিযোগ, জোর করে, টেনে হিঁচড়ে-চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চাকরিপ্রার্থীদের। এরপর আবার টেট পাশ করা পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ধুন্ধুমার বেঁধে যায় নভেম্বরেও।  এমনকি চাকরিপ্রার্থী অরুণিমা পালকে এক পুলিশ কর্মী কামড়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। উলটে দিন শেষে আক্রান্ত অরুণিমা পাল সহ টেট বিক্ষোভের কারণে গ্রেফতার ৩০ জন চাকরিপ্রার্থী।


বগটুই অগ্নিকাণ্ড 
গত ২১ মার্চ রামপুরহাটের বগটুই মোড়ে বোমার আঘাতে খুন হন বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখ। সেই খুনের পর রাতে বগটুই গ্রামের ১০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তার জেরে ১০ জনের মৃত্যু হয়। গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করে 
সিবিআই। ইতিমধ্যে এই ডিসেম্বরে এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত লালন শেখের মৃত্যু হয়। সিবিআই হেফাজতে বগটুই হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত লালন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। লালনের মৃত্যুর জন্য সিবিআইকেই দায়ী করে বিক্ষোভ দেখায় গ্রামের মানুষ ।


বছরের একেবারে শেষ লপ্তে দাঁড়িয়ে আমরা। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে পর্যুদস্ত রাজ্য সরকার। ঠিক এই মুহূর্তে ফের অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে আনা শিবঠাকুরের অভিযোগ ঘিরে চলছে তোলপাড়। সেই সঙ্গে উত্তাপ শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে একের পর এক মামলা নিয়ে। কেন্দ্রীয় এজেন্সির হেফাজতেই আছে তৃণমূলের দুই হেভিওয়েট। এরই মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী সহ বিজেপির অন্যান্য নেতাদের চ্যালেঞ্জ ছিল ডিসেম্বরে বড় কিছু ঘটবে। রাজ্যের সবচেয়ে বড় চোর ধরা পড়বে, ফের বিস্ফোরক  দাবি করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। দিন স্থির করে দিলেও এখনও বড় কিছু ঘটেনি বছরের শেষ লগ্নে। তবে এখনও দিনকতক বাকি । এর মধ্যে আর কী ঘটে তার দিকেই তাকিয়ে রাজ্যের মানুষ।