World Environment Day 2023: 'ভেবেছি যত পারি গাছ রেখে যাব...', পরিবেশ বাঁচাতে গাছ পোঁতাই নেশা শ্যামলের

Shyamal Jana: কাঁথির কাছে একটি স্কুলে পড়ান তিনি। আর ছুটি জমিয়ে চলে যান গাছ পুঁততে। খরচ ওঠে জমানো টাকাতেই। কী স্বপ্ন দেখেন শ্যামল জানা?

Continues below advertisement

কলকাতা: পেশায় শিক্ষক। প্রাথমিক স্কুলে শিশুদের ভিত গড়েন তিনি। আর ছুটি পেলে বেরিয়ে পড়েন এদিন-সেদিক। কখনও রাজ্যের কোনও জেলায়, কখনও আবার ভিনরাজ্যে। লক্ষ্য একটাই গাছ পোঁতা। অন্তত দেড় দশক ধরে এমনটাই করে আসছেন পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা শ্যামল জানা।

Continues below advertisement

কাঁথির কাছে কুলাই পদিমা জুনিয়র বেসিক স্কুল। সেখানেই পড়ান শ্যামলবাবু। থাকেনও পূর্ব মেদিনীপুরেই। কিন্তু তাঁর পরিচয় এখন শুধু স্কুল বা বাড়ির গন্ডিতে আটতে নেই। পরিবেশকর্মী হিসেবে তাঁর নাম এখন পরিচিত রাজ্যের বাইরেও। প্রবাদ রয়েছে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'। কেন এমন করেন? শিক্ষক শ্যামল জানার কথায়, 'আমাদের জীবন তো কাটিয়ে দিলাম। পরের প্রজন্ম যারা, যারা এখন নীচু ক্লাসে পড়াশোনা করছে। তাদের যদি বৃক্ষরোপণের বার্তা না দিই। ভবিষ্যতে বিপদ হবে।'

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে...
জীবনে ৩বার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিলেন শ্যামলবাবু। ৩ বারই প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। তাই শ্যামল জানার চোখে জীবনের মানে হয়তো আমার-আপনার থেকে অনেকটাই আলাদা। কী ভাবে দেখেন? প্রশ্ন শুনে শ্যামল বললেন, 'আমি মনে করি আমার জীবনের প্রত্যেকটা দিনই শেষ দিন। মনে করি ঘুম ভাঙলে সকাল, না ভাঙলে সেকাল। কথায় বলে মরার আগে দাগ রেখে যা। আমার তো অনেক টাকা নেই। তাই ভেবেছি যত পারি গাছ রেখে যাব।' গত ১৫ বছর ধরে তাই বৃক্ষরোপণই ধ্যানজ্ঞান পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা শ্যামল জানা। পেশায় শিক্ষক শ্যামল জানার নেশা বৃক্ষরোপণ। যেখানে সম্ভব, যতটা সম্ভব গাছ পুঁতে বেড়ানোই তাঁর লক্ষ্য। এটাই নাকি তাঁর নেশা। বললেন, 'এটা না করলে আমি ভাল থাকতে পারব না।' এমন নেশায় পরিবার-আত্মীয় স্বজন পাশে থাকেন? শুনেই তিনি হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, 'কেউ কেউ বলত পাগল। এখন তাঁরাই বলে ভাল কাজ করছি। এটাই পাওনা।'

প্রথম কাজ:
নিজের জেলাতেই প্রথম এই কাজ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলায় ঘুরে ঘুরে বৃক্ষরোপণ করেছেন। লক্ষ্য ছিল উত্তর-পূর্ব ভারত। অসম ও মেঘালয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু মনিপুরে তখন অশান্তি চলায় সেখানে যেতে পারেননি। যেতে পারেননি অরুণাচল-নাগাল্যান্ডেও। তাঁর স্বপ্ন দেশের সব রাজ্যে অন্তত একটা করে বৃক্ষরোপণ করার। তবে শুধু দেশের মধ্যেই আটকে থাকতে চান না তিনি। আপাতত নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় বৃক্ষরোপণের বার্তা পৌঁছতে চান। সেটা ঠিকমতো মিটলে সবকটি মহাদেশে গাছ লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী বার্তা দিতে চান তিনি। স্বপ্নটা অনেক বড়, কিন্তু তার চেয়েও বড় শ্যামল জানার অদম্য জেদ। 

বটে ভরসা:
এখনও পর্যন্ত শ্যামল জানা ৭১০টি বটগাছ রোপণ করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু বটগাছই কেন? তিনি বলেন, 'এটা জাতীয় বৃক্ষ। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে।' আরও একটা কারণ রয়েছে। তিনি জানালেন, বটগাছের কাঠ আসবাব তৈরি বা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার হয় না। ফলে কাঠের জন্য গাছ কাটার বিপদ এড়ানো যায়।

ভালবাসা-ভরসা-আতিথেয়তা:
যাতায়াত-খাওয়া খরচ, গাছের টাকা। জমানো থেকেই খরচ চলে। তবে ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ পরিচিত হয়েছেন অনেকের সঙ্গেই। সেখান থেকেই অফুরন্ত সমর্থন পান শ্যামল। কীভাবে? সম্প্রতি অসম গিয়েছিলেন তিনি, বৃক্ষরোপণের বার্তা দিতে। বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্য়মে অনেকেই জানতে পারেন। তার জন্য কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছেন। কেউ গাছের দাম দিয়েছেন। শ্যামলবাবু বললেন, 'এই অসম গেলাম। কয়েকদিন ছিলাম। থাকা-খাওয়া মিলিয়ে সব মিলিয়ে ৮০০ টাকা খরচ হয়েছে।' বাকিটা? শ্যামল জানা জানালেন, ওখানে অনেকেই দুপুরে-রাতে খাওয়ার নেমতন্ন করেছিলেন। গাছ পোঁতার সময় পরিচয় জেনে, তাঁকে বাড়িতে একরাত থেকে যাওয়ার অনুরোধও করেছেন কেউ কেউ। এভাবেই দিন কেটেছে অসমে?

তাহলে কী মানুষ সচেতন হচ্ছেন? নিজে নিজে যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই বার্তা বাকিদের কাছে পৌঁছচ্ছে? এই ব্যাপারে ১০০ শতাংশ আশাবাদী শ্যামল জানা। এখন প্রচুর মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন তিনি। কেউ কেউ তাঁকে দেখে নিজের এলাকায় গাছ লাগাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সময় দিতে পারছেন না, কিন্তু অর্থ দিয়ে, গাছ কিনে দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁর আশা আগামী প্রজন্ম আরও সচেতন হবে, গাছ নিয়ে তারা ভাববে। তাদের জন্য যতদিন পারেন নিজে গাছ লাগিয়ে বার্তা দিতে চান তিনি।

রাজনীতির পরিসরে পরিবেশ:
পরিবেশ নিয়ে বহু কাজ করে থাকেন অনেকে। ব্যক্তিগত ভাবে অনেকে পরিবেশ বাঁচানোর কাজ করছেন, অনেক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু শ্যামলবাবু চান রাজনীতির পরিসরেও আসুক পরিবেশ। রাজনৈতিক দলগুলি পরিবেশ নিয়ে রাজনীতির কথা বলুক। অন্তত একটা রাজনৈতিক দল তাদের ইস্তাহারে বলুক যে তারা জিতলে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ পুঁতবে। বদল শুরু হবে সেখান থেকেও।

স্কুল-বাড়ি সামলে এত কাজ। নিজেকে ক্রমাগত উজ্জীবীত করেন কীভাবে? কোনও মন্ত্র রয়েছে? শ্যামল জানা জানালেন তাঁর স্লোগান রয়েছে একটা- 'থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, বৃক্ষরোপণ বিশ্বজুড়ে'। তাঁর কথায়, 'সারা পৃথিবীটাই আমার বাগান। সেই বাগানে গাছ লাগাতে চাই।' জেলা-রাজ্য-দেশের গন্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বকে নিজের বলে ভাবতে শেখাচ্ছেন শিক্ষক শ্যামল জানা। স্বপ্ন দেখেন, পরের প্রজন্মও একদিন সারা বিশ্বকে নিজের বাগান ভাববে। তখন আর আলাদা করে আর সচেতনতা ছড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। তিনি একদিন থাকবেন না, তাঁর গাছ থেকে যাবে আর বাকিদের মাধ্যমে থেকে যাবে তাঁর স্বপ্ন। 

আরও পড়ুন: নিজের হাতে ৮ হাজার গাছকে সন্তানস্নেহে পালন, ১১২ বছরেও কীর্তি গড়ে চলেছেন ভারতের 'বৃক্ষ-মাতা'

Continues below advertisement
Sponsored Links by Taboola