প্রিয়াঙ্কা দত্ত: 'উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে। রাজদ্বারে শ্মশানে চ যতিষ্ঠটি স বান্ধব।' পরিচিত এই চাণক্যশ্লোকটির তাৎপর্যের যথার্থ ব্যাখ্যা মিলেছে এই মহামারীর (Pandemic) আবহে। দীর্ঘ দু'বছর, করোনার (Covid-19) প্রকোপে যখন কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছিল গোটা বিশ্বের, চারিদিকে যখন শ্মশানের হাহাকার, মৃত্যুমিছিল। তখনও এই বঙ্গভূমির (Westbengal) মানুষকে ভরসা জুগিয়েছিল একাংশ। বিপন্ন সময়েও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মরা গাঙে তরী ভাসানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁরা। সফল কতটা হওয়া গেল তা তো ভবিষ্যতে বিচার্য। আপাতত ফিরে দেখা যাক (Year Ender), সেই টুকরো ঘটনাগুলো যা সত্যিই নজিরবিহীন।
তারুণ্যের উদ্যম (Red Volunteer)
মহামারীর আবহে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিল এক ঝাঁক তরুণ-তুর্কি। রেড ভলান্টিয়ার্স। কোভিড পরিস্থিতিতে সিপিএমের ছাত্র-যুবদের সাহসী সেই ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল সব মহলেই। বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পরেও, দলবদলের আবহে লাল স্বেচ্ছাসেবকদের এই কর্মকাণ্ড বাঁচিয়ে নিয়েছিল তামাম শহরবাসীকে। কখনও করোনা আক্রান্ত প্রবীণের ত্রাতা, কখনও সৎকারে আত্মীয় হয়ে বৈতরণী পার। গোটা বছর ধরে সমন্বয়ের নজির গড়ে দল-মত নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল রেড ভলান্টিয়াররা।
মহামারীর হেঁসেল
প্রথম ঢেউ-এর ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঢেউ। তখন দিশেহারা বঙ্গবাসী। কারও পেটে ভাত নেই। কোথাও বা রোগীর পথ্য মিলছে না। ঠিক এমন সময়েই অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই শহরেরই একাংশ। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের আনাচে কানাচে শুরু হয়েছিল রান্নাঘর। উদ্দেশ্য একটাই, সাহায্য! গণমাধ্যমে নিজেরাই স্টেটাস দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোভিড-আক্রান্তদের জন্য তাঁরা রান্না করছেন, ঠিকানা দিলে খাবার বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। দিয়েছিলেনও। এভাবেই দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন একদল অসহায় মানুষ।
গ্লেনারিজে কোয়ারেন্টিন সেন্টার (Glenarys)
হোপ! লেখাটা সদা উজ্জ্বল। দার্জিলিং-এর বিখ্যাত বেকারি গ্লেনারিজের বাইরের সেই জায়গা সর্বজন পরিচিত। মহামারী আবহে সেই বেকারির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার স্কোয়ারফুট এলাকা হয়ে উঠেছিল কোয়ারেন্টিন সেন্টার। অক্সিজেন সাপোর্ট, বেড, খাবার নিয়ে শয়ে শয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল গ্লেনারিজ কর্তৃপক্ষ। বলাবাহুল্য যা চরম দুঃসময়েও আদতেই 'আশার' সঞ্চার করেছিল মানুষের মনে।
অঙ্গদানের পথিকৃৎ
বাংলায় অঙ্গদান আন্দোলনের পথিকৃৎ তিনি। করোনায় মৃত্যুর ফলে, অঙ্গদান করা না গেলেও বিদায়বেলাতেও এক অনন্য নজির গড়ে গিয়েছিলেন রাজ্যে অঙ্গদান আন্দোলনের পথিকৃত ও গণদর্পনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ব্রজ রায়। করোনায় মৃত্যুর ফলে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা জানতে ব্রজ রায়ের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। মৃত্যুর পরও নজির গড়লেন মরণোত্তর দেহদান ও অঙ্গদান আন্দোলনের পুরোধা ব্রজ রায়। গবেষণার জন্য করোনায় মৃতের ময়নাতদন্ত। কোভিডে কোন অঙ্গে কতটা ক্ষতি? জানতে আরজি কর হাসপাতালে করা হয় প্যাথোলজিক্যাল অটোপসি।
মহামারী আবহেও একাধিক অস্ত্রোপচারে সাফল্য
করোনা আক্রান্ত মায়ের ডেলিভারির সাফল্য থেকে আক্রান্ত রোগীর জটিল অস্ত্রোপচার। মহামারীর ভয়াবহ সময়েও একাধিক নজির স্থাপন করেছিল রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল। এই সময়েই জটিল অস্ত্রোপচারে প্রাণ বাঁচে এমনই এক শিশুর। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের এক শিশুর জন্মের পরেই দেখা যায়, পেটের উপর যে চামড়ার আস্তরণ থাকে, তা তার নেই। ফলে জন্মানোর পরেই শিশুটির পেটের ভিতরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাইরে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার কথা বলেন তমলুকের হাসপাতালের চিকিৎসকরা। শিশুটির পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাওড়ার ফুলেশ্বরের সঞ্জীবন হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ১ ডিসেম্বর সঞ্জীবন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। জটিল অস্ত্রোপচার এবং চিকিৎসার ফলে শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠেছে।
বাঙালিদের জন্য মুম্বই-এ বঙ্গভবন
দিল্লিতে বাঙালিদের জন্য থাকার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। মহারাষ্ট্রেও তেমন বঙ্গভবন তৈরির প্রস্তাব দেন মমতা। এ রাজ্য থেকে যাঁরা মুম্বই-এর টাটা ক্যান্সার মেমোরিয়াল হাসপাতালে যান তাঁদের থাকার জন্য একটি জায়গা বানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় মহারাষ্ট্র সরকারকে। জানা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে কথা হয়ে গিয়েছে।
'দেব'আলয় (Dipak Adhikari)
মহামারী আবহে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন অভিনেতা-সাংসদ দেব। করোনা আক্রান্তদের জন্য নিজের রেস্তোরাঁ টলি টেলস থেকে খাবার সরবরাহ করেছেন। পাশাপাশি ঘাটালে তাঁর অফিসকে রূপান্তরিত করেছিলেন আইসোলেশন সেন্টারে। থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন রোগীদের। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দেখে চুঁচুড়ার ছোট্ট মেয়ে তিতলির বাবা-র সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন। হাসপাতালের বেড থেকে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা, সবেতেই তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মানুষের। তবে শুধু দেবই নন। সাধারণের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-সহ বহু টেলি তারকা।
করোনাকে ভয় নয়
ছোট থেকেই একটি পা নেই তাঁর। তবে করোনাকালে তা নিয়েই তিনি চষে বেড়িয়েছেন কলকাতা। এটা শামিমার গল্প। এই শহরেরই বাসিন্দা তিনি। একটা পা নেই তাঁর। তবে সেই অবস্থাতেই স্কুটারে চেপে রোগীদের সোয়াব সংগ্রহ করে তা পৌঁছে দিয়েছেন ল্যাবে। মাঝে নিজেও মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তবে যাবতীয় বাধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফের কাজে ফিরেছিলেন শামিমা। শারীরিক প্রতিকূলতা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মনের জোরে জয় করেছেন মহামারী ও মানুষের মন।
আশার আলো এবং আশাকর্মীরা (ICDS Worker)
জলমগ্ন গ্রাম, হাঁড়ির মধ্যে শুয়ে পোলিও টিকা নিচ্ছে একরত্তি। এই ছবিটা অনেকেরই মনে থাকবে। ইয়াসের পর নেটদুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল ক্যানিং-এর এই ছবিটি। টানা বৃষ্টির জেরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-সহ একাধিক এলাকা জলে ডুবে যায়। জলমগ্ন এলাকাগুলিতে তখন ঘরবন্দি শিশুদের পোলিও খাওয়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রশাসনের কাছে। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজে নেমে পড়েছিলেন আশকর্মীরা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সফলও হয়েছিলেন তাঁরা।
ট্রেনে ভ্রাম্যমান ভ্যাকসিনেশন সেন্টার (Aragya)
চলতি বছর 'আরোগ্য'-র সূচনা করেছিল পূর্ব রেল। ভ্রাম্যমান টিকাকরণ সেন্টার থেকে দুয়ারে ভ্যাকসিনেশন, করোনাকালে মানুষের প্রয়োজনে দেখা গিয়েছে নানা অভিনব পদক্ষেপ। এর পর কর্মী ও তাঁদের পরিবারের লোকজনের ভ্যাকসিনেশনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ করে পূর্ব রেল। ট্রেনের কোচকেই ভ্রাম্যমাণ টিকাকরণ সেন্টার বানানো হয়। 'আরোগ্য' নামের বিশেষ ট্রেনে ছিল হেলথ ইউনিট। ছিল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স থেকে করোনা টিকাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা। প্রথমে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছয় ট্রেনটি। প্রত্যেক সফরেই ছিল ভ্যাকসিনের ১৪০টি করে ডোজ। উল্লেখ্য, ট্রেনেই কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি করে নজির গড়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
মৃত্যু মিছিলে ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা (Frontline Worker)
সময়টা ২০২১-এর মে মাস। বাড়ছিল মৃত্যু মিছিল। নিরন্তর পরিষেবা দেওয়ার পর মৃত্যু হয়েছিল বহু চিকিৎসকের। যে সংখ্যাটা ৫০০-রও বেশি। কখনও আলিপুরদুয়ারে স্বাস্থ্যকর্তা কখনও আবার বালুরঘাটের জেনারেল ওয়ার্ডে ডিউটিরত চিকিৎসক। একে একে আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন অনেকেই। করোনায় মারা যান বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্ত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁরা। দুর্ভাগ্যবশত, তালিকাটা বেশ লম্বা। সেখানে রয়েছেন বহু পুলিশকর্মী, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মীরা। গোটা সঙ্কটপর্বে যাঁরা আমাদের নিরন্তর পরিষেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে লড়াইয়ের মাঝে মরামারীর কোপে তাঁদের প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের অবদান ভোলার নয় কোনওদিন।
গোটা মহামারী পর্বে এমন টুকরো হাজারও ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল তামাম দুনিয়া। তবে সঙ্কটের চরম পর্বের আপাতত ইতি ঘটেছে। বছর শেষে 'মুছে যাক গ্লানি'। নতুন বছরে ফের এক হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে পথ চলা জারি থাক। 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে'র মতো পাঠ্য বই-এর পংক্তি বাস্তবেও সত্যি হোক।