কলকাতা: কোনও সিনেমার চিত্রনাট্য বললেও যেন কম বলা হয়। বছর ভর শিরোনামে রইল SSC-র নিয়োগ দুর্নীতি মামলা। আর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে SSC-র উপদেষ্টা, এমনকী মিডলম্যানরাও ধরা পড়েছে সিবিআইয়ের জালে। দফায় দফায় জেরা, একাধিকবার হাজিরার নির্দেশ- এই সব কিছু পেরিয়ে কার্যত কান টানলে মাথা আসা-র মতো হেফাজতে গিয়েছেন শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী থেকে অধিকর্তারা। 


গ্রেফতার পার্থ চট্টোপাধ্যায়: ঘটনা প্রবাহ শুরু হয়েছিল চলতি বছর জুলাই মাসে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে গ্রেফতার (Arrest) হন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ( Education Minister) ও তৃণমূলের তদানীন্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। এসএসসি দুর্নীতি মামলার তদন্তে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে যান ইডি আধিকারিকরা। নাকতলার বাড়িতে প্রায় ২৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে। ২৩ জুলাই ইডির হাতে গ্রেফতার হন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গ্রেফতারির দিনকয়েকের মধ্যে তৃণমূলের মহাসচিব পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। সরানো হয় মন্ত্রিসভা থেকেও।


গ্রেফতার অর্পিতা মুখোপাধ্যায়: পার্থর বাড়ি থেকেই চিরকূটের সূত্র ধরে অর্পিতার টালিগঞ্জে ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালায় ইডি। ঠিক তারপরের দিনই তল্লাশি চালানো হয় অর্পিতার রথতলার ফ্ল্যাটেও। দুটি ফ্ল্যাটে উদ্ধার হয় নগদ ৫০ কোটি টাকা। এবং কোটি কোটি টাকার সোনা। শুধু তাই নয়। পার্থ ও অর্পিতার ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্টেও ৮ কোটি টাকার হদিশ মিলেছে বলে দাবি করা হয় ইডি সূত্রে! উদ্ধার করা হয় একাধিক দলিল। 


গ্রেফতার দুই প্রাক্তন উপদেষ্টা: হাইকোর্ট নিযুক্ত বাগ কমিটির রিপোর্টে নাম ছিল তাঁদের। পার্থ-অর্পিতার গ্রেফতারির এক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই গ্রেফতার করা হয় এসএসসির ২ প্রাক্তন উপদেষ্টাকে। সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার শান্তিপ্রসাদ সিন্হা ও অশোক সাহা। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের হাতে প্রথম গ্রেফতার SSC-র দুই প্রাক্তন উপদেষ্টা। শান্তিপ্রসাদ-অশোক সাহার বাড়িতে গিয়ে একাধিকবার সিবিআই তল্লাশি চালায়। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পরে গত ১০ অগাস্ট গ্রেফতার করা হয় শান্তিপ্রসাদ সিন্হা, অশোক সাহা। সিবিআইয়ের এফআইআরে ১ নম্বরে শান্তিপ্রসাদ সিন্হা, সিবিআইয়ের এফআইআরে ৪ নম্বরে অশোক সাহা। তদন্তে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে গ্রেফতার এসএসসির ২ প্রাক্তন উপদেষ্টা। 


গ্রেফতার মিডলম্যান: গত ২৪ অগস্ট এসএসসি দুর্নীতিকাণ্ডে প্রদীপ সিংহকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সূত্র মারফত জানা যায়, এসএসসি পরীক্ষায় অযোগ্য প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এই ‘মিডলম্যান’ প্রদীপ। অভিযোগ, সেই প্রার্থীদের তথ্য তার পর এসএসসির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিন্‌হা-সহ অন্য কর্তাদের দিতেন।  প্রদীপ সিংহ যে সংস্থায় কাজ করতেন, সেখানকার মালিককে গত ২৫ অগাস্ট গ্রেফতার করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। ধৃত ওই ব্যক্তির নাম প্রসন্ন রায়। প্রদীপের মতো প্রসন্নও ‘মিডলম্যান’-এর কাজ করতেন। গাড়ি ভাড়া দেওয়া একটি সংস্থায় কাজ করতেন প্রদীপ। ২৫ অগস্ট সল্টলেকে ওই সংস্থার দফতরে তল্লাশি চালায় সিবিআই। সেই সূত্র ধরেই সংস্থার মালিক প্রসন্নকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে জানা যায় ।


গ্রেফতার কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়: নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে একাধিকবার কল্যাণময়কে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রায় ৬ ঘণ্টা জেরার পরে কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে সিবিআই। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি গ্রেফতার। কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করল সিবিআই।নিয়োগ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কল্যাণময়। সিবিআই সূত্রে জানা যায়, শান্তিপ্রসাদ সিন্হার সঙ্গে কল্যাণময়ের সরাসরি যোগের অভিযোগ সিবিআইয়ের। ভুয়ো নিয়োগপত্রে সই করতেন কল্যাণময়, নাম ছিল বাগ কমিটির রিপোর্টেও। 


গ্রেফতার সুবীরেশ ভট্টাচার্য: বাগ কমিটির রিপোর্টে ছিল তাঁর নাম। তিনি এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং তদানীন্তন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের রিপোর্টে বলা হয় যে, এসএসসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য-সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে পদক্ষেপ করা উচিত। গত আগাস্টে শিলিগুড়িতে এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যানের বাড়িতে যায় সিবিআই। সুবীরেশ ভট্টাচার্যর বাড়িতে অভিযান চালায় ১০ জনের সিবিআই প্রতিনিধি দল। SSC নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়, বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে দফায় দফায় অভিযান চালান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী অফিসাররা। দীর্ঘক্ষণের অভিযানের পরে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই।


বড়দিন, নতুন বছরেও হেফাজতেই ধৃতরা: ২২ ডিসেম্বর আদালতে তোলা হয় নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের ধৃতদের। ফের খারিজ হয়ে যায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত ৭ জনের জামিনের আর্জি। ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জেল হেফাজতে থাকতে হবে তাঁদের। অর্থাৎ দুর্গা পুজো, কালী পুজোর মতোই এবার বড়দিন এবং বর্ষবরণও গরাদের আড়ালেই কাটবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর।


আরও পড়ুন: Anubrata Mandal : হাজিরা এড়ানো থেকে নাটকীয় গ্রেফতার, শিব-ট্যুইস্ট থেকে রাজনৈতিক তরজা, বছরভর আলোচনায় অনুব্রতর গ্রেফতার-নামা